More

Social Media

Light
Dark

হরধোনি

গত বছর অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে আমি প্রথম দেখি ছেলেটিকে। বানতলার কাছে কী একটা ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে আছি, নাম মনে নেই, হঠাৎই চোখ চলে যায় ছেলেটির দিকে। বড় রাস্তার পাশের মাঠে একা একা ছুটছিল। শেষ বিকেলের পড়ন্ত কমলা আভা পিঠে নিয়ে। গায়ে ময়লা একটা স্যান্ডো গেঞ্জি।

নিচে কালো মতো জার্সি কাপড়ের প্যান্ট। রুক্ষ চুল, কালো মুখে দারিদ্রের চাপ স্পষ্ট। দশ-বার পাক দৌড়ে থামলো সে। একটা তবড়ানো বোতল থেকে কিছুটা জল গলায় ঢেলে এবারে শুরু হলো স্কিপিং। তা প্রায় শো পাঁচেক তো হবেই। সামনে লড়ির চাকা ফেঁসে যাওয়ায় মিনিট কুড়ি মতো আটকে ছিলাম। বেশির ভাগ সময়ই চোখ আটকে ছিল ছেলেটার দিকে। স্কিপিংয়ের পর শুরু হলো ফুটবল নিয়ে কসরত।

গায়ের গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে শরীরে বসে গেছে ততক্ষণে। সূর্য ডুবেছে অনেকক্ষণ। ফাঁকা মাঠ খা খা করছে। কিন্তু ছেলেটার ভ্রুক্ষেপ নেই। একবারের জন্য থামছে না। কোনও এক আদিম, অদম্য জেদ যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে তাঁকে। বোধহয় ওই বলটাকে আঁকড়ে ধরেই স্বপ্ন দেখেছে সে। একদিন এই পাড়ার মাঠটাকেই তাঁকে কলকাতা ময়দানে বদলে ফেলতে হবে। স্যান্ডো গেঞ্জি আর ময়লা প্যান্ট বদলে যাবে লাল-হলুদ বা সবুজ-মেরুনে। হারাতেই হবে দারিদ্রের অমোঘ পিছুটান। যে স্বপ্নকে আশ্রয় করে লড়াইয়ে নেমেছে মফঃস্বলের ছেলেটা তার নাম মহেন্দ্র সিং ধোনি।

ads

সঞ্জয় আমাদের সঙ্গে স্কুলে পড়তো। ফাইভ থেকে মাধ্যমিক- এমন কখনও হয়নি যে সে ক্লাসে দ্বিতীয় হয়েছে। অঙ্ক, বিজ্ঞান হোক বা বাংলা-ইংরেজি সবেতেই প্রথম। স্যার প্রশ্ন শেষ করার আগেই তাকে উত্তর বলতে বহুবার শুনেছি আমরা। তা এ হেন সঞ্জয়কে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর পর দেখি কেমন মুষড়ে পড়েছে। ভাবলাম, কোনও বিষয়ে বোধহয় মনের মতো নাম্বার পায়নি, তাই হতাশ।

কিন্তু না, সব বিষয়েই নাম্বার নব্বইয়ের ঘরে। শুধু বাংলায় আশি ছুঁয়ে থেমেছে। ‘কী হলো তোর?’ ‘কথা বলছিস না কেন?’, আমার প্রশ্নবানে জর্জরিত সঞ্জয় আস্তে আস্তে বললো, ‘সাইন্স নিয়ে পড়া আর হলো না রে। বাবার পক্ষে এত খরচ টানা সম্ভব না। আমার বাবা তোদের মতো আলাদা, আলাদা বিষয়ে মাস্টার দিতে পারবে না। সংসারে অনেক খরচ’ কী করেন কাকু? ‘রিকশা চালায়’ জবাবে আর কোনও কথা না বাড়িয়ে চলে গেছিল সে। তখন ফোন ছিল না। দু’জনে আলাদা স্কুলে চলে যাওয়ায় মাঝে দীর্ঘ সময় যোগাযোগও ছিল না।

কিছু দিন আগে বাজারে হঠাৎ দেখা হলো সঞ্জয়ের সঙ্গে। নানা গল্পের পর জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম এখন কী করিস? ‘আমি অডিট এন্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার।’ সত্যি খুব খুশি হয়েছি। সঞ্জয়কে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে। আমাদের ব্যাচে ওই ছিল সেরা ছেলে। পুনরায় যোগাযোগ হওয়ায় অতীত প্রসঙ্গ টেনে জানতে পারি, মাধ্যমিক পাস করেই ছাত্র পড়াতে শুরু করে ও। পাশাপাশি করেছে সাইবার ক্যাফেতে হিসাব রাখার কাজ। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রমে পৌঁছেছে আজকের জায়গায়। সঞ্জয়ের এই অক্লান্ত পরিশ্রম আর হার না মানসিকতার নাম মহেন্দ্র সিং ধোনি।

কিংবা আমার পুরানো অফিসের বাসু দা। পুরো নাম বিশ্বজিৎ বাসু। ডেইলি ওয়েজ আর্নার হিসেবে কাজ করতেন। দিনে আয় তিনশো টাকা। আমাদের বিভাগের যাবতীয় ফাইল, কাগজ-পত্র গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। কোন ফাইলে কী কাগজ আছে, কোন ফাইল কোন আলমারিতে তোলা, নিজের পুরানো কাজের রেফারেন্স খুঁজতে কোন ফাইল নামাতে হবে, নিজেরা জানতাম না।

কিন্তু, বাসু দা জানতেন। আমরাও নিশ্চিন্তে ছিলাম। নিজেদের প্রয়োজন মিটে গেলে যেখানে সেখানে ফেলে রাখতাম দরকারি কাগজ পত্র। জানতাম ষাট ছুঁই ছুঁই লোকটার ভুল হবে না। একটা কাগজও এদিক ওদিক হবে না। একদিন অফিসে ডাক দিয়ে দেখি বাসু দা নেই। কী ব্যাপার এমন তো হয় না। দু’বছরের বেশি হলো বাসু দা-কে না বলে ছুটি নিতে দেখিনি। এবং সেটাও বছরে দু-এক দিন। পরের দিনও অফিসে নেই বাসু দা।

কী একটা দরকারে এক মাস আগের একটা ফাইল এখুনি লাগবে। বাসু দা ছাড়া সেই ফাইল উদ্ধার করা মানে, খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজা। ফোন ব্যবহার করতেন না। গাড্ডায় পরে অনেক খোঁজ খবর করে জানা গেল, বাসু দা আগামী কয়েক দিনও আসবেন না। তাঁর ছোট্ট মেয়েটা পথ দুর্ঘটনায় মারা গেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল বাসু দা-র কথা ভেবে। সঙ্গে রাগ হলো নিজের উপর। কেন বাসু দা-র উপরে এতো নির্ভরশীল হলাম। নিজের দরকারে যে জিনিস প্রয়োজন তার হদিশ রাখাটাও আমার কাজের মধ্যে পরে! দিনের পর দিন নিঃশব্দে যে নির্ভরশীলতা বাসু দা আমাদের দিয়ে গেছেন তার নামও মহেন্দ্র সিং ধোনি।

আসলে মহেন্দ্র সিং ধোনি তো শুধু নাম নয়। ধোনি মানে ছোট শহরের স্বপ্ন, শেষ ওভার পর্যন্ত হার না মানা একটা লড়াই, দেশের জার্সি গায়ে নি:শব্দে নির্ভরতা দিয়ে যাওয়া বিস্ময়। একটু প্রচলিত পথ ছেড়ে হেঁটে দেখুন, চিরায়িত বিশ্বাস ছেড়ে হাটকে ভেবে দেখুন, দেখবেন আপনার মধ্যেও ধোনি আছেন। আমাদের সবার মধ্যে আছেন। ‘হার এক মে ধোনি হ্যায়’। আর এটাই ভারতের ‘হরধোনি’!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link