More

Social Media

Light
Dark

শৈল্পিক ফিনিক্স

বিখ্যাত ইংরেজ লেখক রস কিং তাঁর শ্রেষ্ঠ তিনটি বইয়ের প্রধান বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন নবজাগরণ যুগটিকে। বস্তুত, রস সাহেবের মতো সেকালের নবজাগরণকে জনমানসে ব্যক্ত করতে পারার মতো লেখক খুব কমই আছেন। অনুপম শিল্পকীর্তি, আশ্চর্য সব শিল্পের নিদর্শন এবং মধ্যযুগীয় নবজাগরণের বিন্যাস পরিবেশনে তিনি বারেবারে আশ্রয় খুঁজেছেন ইতালি দেশটিতে।

সিস্টান চ্যাপেলের দেওয়াল জুড়ে আঁকা মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ফ্রেস্কো পেন্টিং এবং ডেভিডের সৌকর্য তাঁর কলমের বুননে হয়ে উঠেছে অনন্য। মিলান শহরে বসে বাইরে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইতালির রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাট এবং ভেতরে নিজের মনের অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্রমাগত ক্ষয় হতে থাকা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি নামের এক জিনিয়াস আঁকতে বসেছেন একটি ছবি। যে ছবিটি পরবর্তী জীবনে ইতালিসহ গোটা ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলির একটি হিসেবে পরিচিত হবে, হৃদয়ের গোপনে বিরাজমান হয়ে থাকবে – দ্য লাস্ট সাপার।

রস কিংয়ের প্রতিটি লেখায় তাই নানান আঙ্গিকে কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়েছে এই দেশটির প্রতি। গুটেনবার্গের ছাপাখানার বিপ্লব ঘটে যাওয়ার আগে গোটা ইউরোপ জুড়ে বহু প্রাচীন গ্রিক, রোমান পুঁথির নির্যাসের ধারক ও বাহক ছিলেন সে যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বইবেচিয়ে ভেস্পাসিনো দ্য ভিস্তিক্কি।

ads

হাতে লেখা পুঁথি নকল করে ছড়িয়ে দিতেন দেশ-বিদেশে। আর তাঁর কল্যাণেই ফ্লোরেন্স হয়ে উঠেছিল সে নবজাগরণের যুগে ইতালির সেরা বিদ্বজ্জনদের আড্ডাখানা। এমনই সব অজানা তথ্যের ভাণ্ডার হাজির করে বুড়ো সিধুজ্যাঠা রস কিং প্রণতি জানিয়েছেন ইতালি দেশটির প্রতি। তৎকালীন রেনেসাঁ যুগের অগণিত শ্রেষ্ঠ কীর্তি বেরিয়েছে এই দেশটিকে কেন্দ্র করে।

কিন্তু ইতালির ফুটবলের সঙ্গে মধ্যযুগীয় রেনেসাঁর তো কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে পরপর দুটি বিশ্বকাপ জিতে নেওয়ার পর অক্ষশক্তি হিসেবে ইতালির আগমনের সঙ্গে অ্যাঞ্জেলোর ডেভিডের কোনও সম্পর্ক নেই। অথচ রেনেসাঁ বাদ দিয়েও ইতালি ফুটবলকে দেখা সম্ভব নয়।

আগে ডিফেন্স, পরে অ্যাটাক – এই ঘরানার চিরাচরিত অভ্যাসে ইতালি জন্ম দিয়েছে এমন কিছু গোলকিপার এবং ডিফেন্ডারের, যারা সে দেশের ফুটবলকে হৃদয়ের মণিকোঠায় পৌঁছে দিয়েছে। শিল্পের দেশ ইতালি, শিল্পের অজস্র বিভাগের মধ্যে তারা সামিল করেছে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাটিকেও।

১৯৮৫। সার্জিও বাতিস্তিনির দ্বিতীয়ার্ধের চোট এবং মালদিনির মাঠে নামা – এই নিয়ে একটা বড় কবিতা লেখা যায়। শুধু এইটুকু ঘটনা ইতালীয় ফুটবলে ঘটিয়ে দিয়েছিল বিপ্লব। এসি মিলানে সেসময়ের সেরা ফুলব্যাক বাতিস্তিনির চোট যেন অস্তগামী সূর্য, সেইখানে ভোরের প্রথম রাঙা আলো হয়ে উদয় হলেন পাওলো মালদিনি। যার জন্মই মিলানে।

বাবা সিজার মালদিনি ত্রিয়েস্তে থেকে মিলানে খেলতে চলে আসার পর, একটানা মিলানেই থেকে গেলেন। সেখানেই প্রথম ফুটবলে হাতেখড়ি ছোট পাওলোর। মিলানের সিনিয়র স্কোয়াডে জায়গা মিলল ১৯৮৪-৮৫ সিজনে। আরেক মিলান লেজেন্ড কোচ নিলস লেইডহোমের টিমে স্কিলফুল মালদিনির জায়গা পেতে বেশি সময় লাগেনি, কারণ লেইডহোম রোমাতে সোনার সিজন কাটানোর সময় বেশি করে জোর দিতেন ডিফেন্সিভ ছকের উপর। স্কিলফুল এবং ইন্ডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্সিতে ভর করে বিখ্যাত ৪-১-২-১-২ ছকে দল নামাতেন। সেখানে ফুলব্যাক হিসেবে দুরন্ত পারফর্ম করা বাতিস্তিনির উদিনেস ম্যাচে চোট পাওয়া এক কথায় সোনার দরজা খুলে দিল পাওলো মালদিনির সামনে।

এরপর থেকে, টানা পঁচিশটি বসন্ত মালদিনি কাটিয়েছেন সান সিরো এরিনাতেই। কঠিন ট্যাকল, অনবদ্য ভিশন এবং ফুলব্যাক হিসেবে লেফট-রাইটে পজিশন চেঞ্জ করেও খেলেছেন। শুরু করেছিলেন লেফটব্যাক হিসেবেই। পরে পুরোপুরি ফুলব্যাক হয়ে যাওয়ার পর দিব্যি ওভারল্যাপেও উঠে যেতেন মাঝে মাঝে। ২০০৫-০৬ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে লিভারপুলের বিরুদ্ধে প্রথম গোল এসেছিল মালদিনির হেডেই।

এই বাঁ-দিক ধরে আক্রমণে উঠে আসার সুযোগ তাঁকে করে দিয়েছিলেন পরবর্তীতে মিলানের কোচ হয়ে আসা বিখ্যাত ট্যাকটিশিয়ান আরিগো সাচ্চি। সাচ্চির দল মূলত ৪-৪-২ ফর্মেশনে খেলত। আরিগো সাচ্চি একদিকে যেমন ট্র্যাডিশনাল ইতালিয় ডিফেন্সকে গুরুত্ব দিতেন, তেমনই মাঝমাঠে বল বেশি হোল্ড না করে দ্রুত পাস খেলে আক্রমণে জোর দিতেন।

মিডফিল্ড থেকে অপনেন্টের হাফব্যাকের দিকে প্রেসিং করার ওপর জোর দিতেন। ফলে, মিলান যখন আক্রমণের সুযোগ পেত তখন বাঁ-দিক থেকে বল নিয়ে ওভারল্যাপে দ্রুত উঠে আসার সুযোগ পেতেন মালদিনি। লেফটব্যাক থাকাকালীন বাঁ-দিকে মালদিনির ক্রমাগত এই ওঠানামা মিলানের আক্রমণভাগে প্রভূত সাহায্য করল। ফলে রুড গুলিট, মার্ক ভান বাস্তেন, দোনাদোনি – বহু গোল করার সুযোগ পেলেন। স্কুদেত্তো, কোপা ইতালিয়া সহ ট্রফিও ঢুকল রোসোনারির ট্রফিরুমে।

তবু মিলানের হয়ে সাফল্যের সর্বোচ্চ সিঁড়িতে বসে থাকলেও দেশের জন্য কখনও কোনও ট্রফি জেতা হল না মালদিনির। পাওয়া হয়নি বহু কাঙ্ক্ষিত ব্যালন ডি অর। ১৯৯৪ এ আমেরিকা মালদিনির কাছে স্বপ্নভঙ্গের দিন। সুপারস্টার রবার্তো বাজ্জিওর পেনাল্টি মিস তরুণ মালদিনিকে ছুঁতে দেয়নি বিশ্বকাপ। ২০০০ এর ইউরোর ফাইনালে হার, ২০০২ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হেরে বিদায় নেওয়ার পর ২০০৬ বিশ্বকাপে আর নীল জার্সিতে তাকে দেখা যায়নি। অথচ সে বছরই ফাবিও গ্রসোর শেষ কিকটা ইতালিকে এক মায়াভরা রাত উপহার দিল।

বিখ্যাত ইতালিয়ান স্ট্রাইকার আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরো বলেছিলেন – কিছু প্লেয়ার হয় গ্রেট, কিছু ওয়ার্ল্ড ক্লাস। এদেরকেও থামাতে হলে আমি মালদিনি ছাড়া কাউকে ভাবতে পারি না। মালদিনি পৃথিবীর ফুটবল ইতিহাসে হাতে গোনা কয়েকজন খেলোয়াড়দের মধ্যে পড়েন, যাঁরা ক্লাব ও দেশ মিলিয়ে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অ্যাপিয়ারেন্স দিয়েছেন। অসাধারণ ফুলব্যাক, লেফটব্যাক হওয়ার পাশাপাশি পরবর্তীতে এই ৩ নম্বর জার্সিধারী ছিলেন অসাধারণ অধিনায়কও।

মালদিনি সেই খেলোয়াড়, যে প্রথম জীবনে পথপ্রদর্শক হিসেবে ইতালির আরেক সর্বকালের সেরা ডিফেন্ডার ফ্র্যাঙ্কো বারেসিকে টিমমেট হিসেবে পেয়েছে। পরবর্তীতে যে জায়গায় খেলতে আসবেন ইতালীয় ফুটবলের কর্ণ আলেজান্দ্রো নেস্তা। মালদিনি ইতালির জলমগ্ন পথে বৈঠা হাতে নৌকো বয়ে চলা এক অসাধারণ মাঝি। ইতালীয় ফুটবলকে, ইতালীয় ডিফেন্সকে একইভাবে, একই ফর্মে একাধারে নেতৃত্ব দিয়ে যাওয়া এই ক্যাপিটানোর কাছে আটকে গেছেন নাজারিও রোনালদো, ফিগো, জিদান, মাইকেল আওয়েন, বেকহ্যাম, বাতিস্তুতা এবং শেষ বয়সে মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো সহ বহু বহু তাবড় স্ট্রাইকার।

মালদিনির ডিফেন্সিভ ফুটবল ইতালিকে দেখিয়েছে নতুন ভোর। সান লোরেঞ্জোর আর্কিটেকচার, লিওনার্দোর দ্য লাস্ট সাপারের মতো শিল্পকলার শহরে এক ফিনিক্স পাখি গোটা জীবনটা উৎসর্গ করে দিলেন সে শহরের একটা ফুটবল ক্লাবকে। ফ্র্যাঙ্কো বারেসি বলেছিলেন, ‘ও যখন প্রথম এসেছিল তখন ওকে সেভাবে শেখানোর কিছু ছিল না। ও তখন অলরেডি স্টার!’

ছেলেবেলায় জুভেন্টাসের ভক্ত ছিলেন মালদিনি। স্ট্রাইকার হতে চাইতেন। হয়ে গেলেন ডিফেন্ডার। ঠিক দাদু আর বাবার মতোই। জুভেন্তাসের ভক্ত শুনে হেসে বাবা সিজার মালদিনি বলেছিলেন – পাওলো মিলানের জন্য নিবেদিত প্রাণ।

মালদিনি সান সিরোর সবুজ ঘাসে পা রেখেছিলেন শুধু ফুটবল খেলবেন বলে। অবসরের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া পাওলো মালদিনি ইতালির এক ফুটবল বিপ্লবী। কেউ যান্ত্রিক হয়, কেউ শৈল্পিক। মালদিনি দু’রকমই। শৈল্পিক ভঙ্গিতে পরের পর ম্যাচে একইভাবে ডিফেন্স করে যাওয়ার ঐশ্বরিক ক্ষমতা, সেই ‘এল ক্যাপিতানো’র জন্ম আজ এই শিল্প নগর মিলানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link