More

Social Media

Light
Dark

নব লঙ্কার জয়ধ্বনি

১৯৯৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের রাতে লাহোরে একটি ডিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। ডিনার করতে এসেছিল ফাইনালের দুই দল শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়া। সাথে বিশেষ একজন অতিথিও ছিলেন। সেই ডিনার শেষে বিশেষ অতিথির সাথে ছবি তুলেছিল অস্ট্রেলিয়া দল। শ্রীলঙ্কা দলও ছবি তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এই সময়ে শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা বলেন যত ছবি বিশ্বকাপ জয় করেই তুলবেন। সত্যিই পরের দিন লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে এক রূপকথার গল্প লিখেছিল রানাতুঙ্গার দল।

অর্জুনা রানাতুঙ্গা সেদিন তাঁর ক্রিকেটারদের বলেছিলেন, ‘আমরা এখন কোনো ছবি তুলতে চাই না। কারণ আগামীকাল আমরা বিশ্বকাপ জিততে চলেছি। বিশ্বকাপ জয়ের পর আমরা যত খুশি ছবি তুলতে পারব।’

আগের রাতে কথা গুলো শুধু বলার জন্যই বলেননি এই অধিনায়ক। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন তাঁর দলের উপর, তাঁর ক্রিকেটারদের উপর। দলও সেই আস্থার প্রতিদান দিয়েছে। পরের দিন ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে অবাক করে দিল শ্রীলঙ্কা।

ads

তবে সেই গল্পের শুরুটা এত মধুর ছিল না। বিশ্বকাপের আগেই স্বাগতিক দেশ শ্রীলঙ্কায় এক আত্মঘাতি বোমা হামলা হয়। ফলে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে অধিকাংশ দেশই সেই সময় শ্রীলঙ্কায় যেতে রাজি হচ্ছিল না। তবে সেই সময় দেশটির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল দুই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তান। ভারত ও পাকিস্তান একটি যৌথ একাদশ পাঠিয়েছিল শ্রীলঙ্কায় খেলতে। প্রমাণিত হয়েছিল শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের জন্যে নিরাপদ। ভারত-পাকিস্তানের সেই ভূমিকা এই অসময়ে এসে খানিক অকল্পনীয়ও বটে।

সেসবকিছু মিলিয়ে সেটা শ্রীলঙ্কার জন্য শুধু একটা ক্রিকেট বিশ্বকাপই ছিল না। দেশ হিসেবেও শ্রীলঙ্কার অনেক কিছু প্রমান করার ছিল। দেশটির ক্রিকেটাররাই যে সে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল সেটা প্রথম বোঝা গেলো গ্রুপ পর্বে ভারত-শ্রীলঙ্কার ম্যাচে।

ভারত আগে ব্যাট করে শচীনের ১৩৭ রানের ইনিংসে ভর করে করেছিল ২৭২ রান। দিল্লির মাঠে ভারতের এত সমর্থকদের মাঝে সেই ম্যাচ শ্রীলঙ্কার জন্য ম্যাচ জেতাটা বেশ কঠিনই ছিল। তবে শুরুটা করে দিয়েছিলেন সনাথ জয়সুরিয়া। জয়সুরিয়ার ব্যাটিং দেখে অন্য ব্যাটসম্যানরাও বিশ্বাস করেছিল যে জয় পাওয়া সম্ভব। শেষ পর্যন্ত জয় নিয়েই মাঠ ছাড়ে রানাতুঙ্গার দল।

এরপর কোয়াটার ফাইনালে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা। ইংল্যান্ডের দেয়া ২৩৬ রানের লক্ষ্যটা আবারো সহজ করে দেন জয়াসুরিয়া। খেলেন ৪৪ বলে ৮২ রানের এক ইনিংস। প্রায় ১০ ওভার হাতে রেখেই ৫ উইকেটের জয় পায় শ্রীলঙ্কা। সেই ম্যাচের পরই নড়েচড়ে বসেছিল বাকি দলগুলো। শ্রীলঙ্কাকে দেখে তখন মনে হচ্ছিল শুধু ক্রিকেট খেলাটাই তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য না। যেনো ব্যাটে-বলে অনেক কথাও বলতে চাচ্ছে দলটি।

সেমি ফাইনালে আবার সামনে আসে পরাশক্তি ভারত। সেটাও কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সের প্রায় এক লক্ষ দর্শকের স্রোতে মাঝে। আগে ব্যাট করে স্কোর বোর্ডে ২৫১ রান জমা করেছিল শ্রীলঙ্কা। তবে জবাবে দারুণ শুরু করে ভারত। মাত্র এক উইকেটেই ৯৮ রান তুলে ফেলেছিল ভারত। তবে এরপরই শচীনের আউটে কলাপ্স করে ভারতের ব্যাটিং লাইন আপ। ১২০ রানেই ৮ উইকেট হারিয়ে ফেলে ভারত। এরপরই ভারতীয় সমর্থকরা ক্ষেপে যাওয়ায় ম্যাচ থামিয়ে দিতে হয়। তবে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল শ্রীলঙ্কাকে। প্রথমবারের মত ফাইনালে উঠলো এশিয়ার নতুন এক ক্রিকেট পরাশক্তি।

ফাইনালের প্রতিপক্ষ সেই সময়ে ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালি দল অস্ট্রেলিয়া হলেও ম্যাচের আগে খুব বেশি চিন্তিত ছিলনা শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারা। তাঁরা শুধু চেয়েছিল নিজেদের সেরাটা খেলতে। আগে ব্যাট করতে নেমে মার্ক টেইলরের ৭৪ রানে ভর করে ২৪১ রান করে অস্ট্রেলিয়া।

ফাইনালের বড় মঞ্চে এটি বেশ বড় টার্গেট বলে ধারণা করছিল অনেকেই। তবে সব ধোঁয়াশা কাটিয়ে অরবিন্দ ডি সিলভা খেলেন ১০৭ রানের অপরাজিত এক ইনিংস। ফলে সাত উইকেটের সহজ জয়ে আগের রাতে দেয়া কথা রাখেন অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা।

সেদিন শ্রীলঙ্কা কত ছবি তুলেছিল জানা নেই। তবে অনেক কিছুরই জবাব দিয়েছিল দেশটি। স্বাগতিক দেশ হয়েও শ্রীলঙ্কায় ম্যাচ হয়েছিল মাত্র দু’টি। একটি যুদ্ধে জর্জরিত দেশ লিখেছিল ক্রিকেট ইতিহাসের সুন্দরতম রূপকথা। লায়ন্সরা হয়ে উঠেছিল ক্রিকেট বিশ্বের এক নয়া পরাশক্তি।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link