More

Social Media

Light
Dark

দুর্ভাগা এক নেতা

স্টিভেন স্মিথের জীবনটাই একটা প্রশ্নের মতো।

শুরুতে লোকে প্রশ্ন করতো, স্টিভ স্মিথ বোলার, নাকি ব্যাটসম্যান? লেগ স্পিনার হিসেবেই দলে এসেছিলেন। এমনকি লোকে তাকে ওয়ার্নির উত্তরসূরীও মনে করা শুরু করেছিলেন। শেন ওয়ার্ন নিজে তাকে নিয়ে কিছু কাজও করেছেন। একজন লেগস্পিনার হিসেবে ব্যাটিং অর্ডারের নিচের দিকে ব্যাট করতেন।

হ্যাঁ, ঘরোয়া ক্রিকেটে কিছু বলার মতো ইনিংস স্মিথের ছিলো। কিন্তু সেসব ইনিংসকে ছাপিয়ে গেলো জাতীয় দলে এসে স্মিথের ব্যাটিং। নিজের ব্যাটিং দক্ষতা দিয়ে প্রমোশন পেয়ে পেয়ে টপ অর্ডারে চলে এলেন। কালক্রমে সময়ের সেরা ব্যাটসম্যানে পরিণত হলেন।

ads

বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যান তো হয়েছেনই। সেই সাথে সর্বকালের সেরা রেটিংয়ে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের চেয়ে সামান্য পিছিয়ে সর্বকালের দ্বিতীয় সেরা রেটিংধারী ব্যাটসম্যানও হয়েছেন। অনেকের মতেই আধুনিক যুগের সেরা দুই ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি ও স্টিভ স্মিথ।

তার মানে, এই প্রশ্নটার উত্তর ব্যাট দিয়ে দিয়েছেন। বলে দিয়েছেন, এককালে স্পিনিং অলরাউন্ডার থাকলেও এখন তিনি কালজয়ী ব্যাটসম্যান। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে স্টিভ স্মিথকে ঘুরতে হয় আরেকটা প্রশ্ন সাথে করে।

ক্রিকেট বিশ্বের সামনে প্রশ্ন, এই স্টিভেন স্মিথ কি একজন ভিলেন? নাকি বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো একজন ট্রাজেডির নায়ক?

স্মিথকে ভিলেন মনে করেন ক্রিকেটের শুদ্ধতাবাদীরা।

নিউল্যান্ডের বল ট্যাম্পারিং কেলেঙ্কারির ‘হোতা’ হিসেবে শাস্তি পাওয়ার পর থেকে বিশ্বসেরা এই ব্যাটসম্যানের কপালে যেনো লেগে গেছে একটা কলঙ্কের সিল। স্টিভ স্মিথকে দেখলেই আগে তাঁদের মনে আসে ‘কেলেঙ্কারি’ শব্দটা। কিন্তু আসলেই কি তাই? আসলেই কী স্মিথ, ক্রনিয়ে, আজহারউদ্দীন, সেলিম মালিক কিংবা শেন ওয়ার্নের মতো কোনো অপরাধ করেছেন? নাকি লঘু পাপে বড় দুর্নাম নিয়ে ঘুরছেন?

একটু গোড়া থেকে খতিয়ে দেখা যাক। কেপ টাউন টেস্টের তৃতীয় দিন বিকেল বেলায় সম্প্রচারকারী টেলিভিশনের ক্যামেরায় ধরা পড়লো যে, অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ডার ক্যামেরন ব্যানক্রফট বলকে কিছু একটা করছেন। ক্যামেরা আরও জুম করলে বোঝা গেলো হলুদ কিছু একটা দিয়ে বল ঘষছেন তিনি। মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনে এই দৃশ্য ভেসে উঠতেই ব্যানক্রফট জিনিসটা চালান করে দিলেন অন্তর্বাসের ভেতর। এরপর আম্পায়ার ডাকলেন তাকে ও স্মিথকে। এই অবস্থায় দুজনই অস্বীকার করলেন বল টেম্পারিংয়ের কথা।

কিন্তু দিনের খেলাশেষে বদলে গেলো দৃশ্য। ব্যানক্রফটকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এলেন স্মিথ। ব্যানক্রফট প্রথমে সবটা স্বীকার করে নিলেন। বললেন যে, ‘স্যান্ড পেপার’ দিয়ে বল ঘষে পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছিলেন।

এরপর স্মিথ বেশ পরিষ্কারভাবে সব দায় নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেন, ‘যা ঘটেছে, তার জন্য আমি দুঃখিত। আমার নেতৃত্বে এই প্রথম এমন কিছু ঘটল। কথা দিচ্ছি, এটাই শেষ। এটা করে কিছুটা সুবিধা নেওয়ার কথা ভেবেছিলাম। সিনিয়ররা ব্যাপারটা জানেন (লিডারশিপ গ্রুপ)। কিন্তু কোচ লেম্যান এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এটা মোটেও গর্ব করার মতো ব্যাপার নয়। আমরা এটা নিয়ে লজ্জিত।’

আর এখানেই সেই প্রশ্নটা।

স্মিথ যদি স্বীকার না করতেন? যদি তিনি বলতেন যে, কিছু একটা ঘটেছে, তবে তাদের জ্ঞাতসারে এরকম কিছু ঘটেনি? কিংবা যদি একেবারেই সংবাদ সম্মেলনে না আসতেন?

দেখুন, বল টেম্পারিংয়ের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছে এর আগে।

খোদ ওয়াসিম আকরাম, ইমরান খান, শচীন টেন্ডুলকার থেকে শুরু করে ইয়ান বোথামের নামে অভিযোগ উঠেছে। এই কিছুদিন আগে ফাফ ডু প্লেসিসের নামেও অভিযোগ উঠেছে। ডু প্লেসিসসহ অনেকের বিপক্ষে ফুটেজের প্রমাণও ছিলো। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই দলের অধিনায়ক আগ বাড়িয়ে এসে বলেননি যে, এটা তাদের সিদ্ধান্তে হয়েছে।

অথচ বল টেম্পারিং বিষয়টাই এমন যে, ফাস্ট বোলারের সুবিধার জন্য এটা দলীয় সিদ্ধান্তেই হয়ে থাকে। মানে, স্টিভ স্মিথ এ ক্ষেত্রে প্রথম পাপী নন। তিনি বরং প্রথম মানুষ, যিনি দায় কাঁধে নিতে ছুটে এসেছেন। এখানে স্মিথের উদ্দেশ্যটা ছিলো খুব মহৎ। তিনি ব্যানক্রফটের মতো একজন তরুনকে বুলেটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে চাননি। কারণ, বল টেম্পারিং নিয়ে যত বিতর্ক হয়, সেটা যে ধরা পড়ে, তাকে নিয়েই হয়।

স্মিথ জানতেন যে, তিনি যদি এই ক্ষেত্রে সামনে এগিয়ে না আসেন, শাস্তি খুব বেশি না হলেও আগামী কয়েক দিন মিডিয়া অন্তত ব্যানক্রফটকে ছিড়ে ফেলবে। সেই ভাবনা থেকেই ব্যানক্রফটের মতো একজন তরুণকে বাঁচাতে নিজে এগিয়ে এসে সবটা দায় নিজেদের কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন।

এই স্বীকারোক্তির ফলে স্মিথ হয়ে গেছেন সবার লক্ষ্যবস্তু। লোকে বল টেম্পারিংকে ফিক্সিংয়ের মতো অপরাধ মনে করছে।

ফিক্সিংয়ের তুলনায় বল টেম্পারিং নিতান্তই ছোট অপরাধ। ফিক্সিং হলো ব্যক্তিগত স্বার্থে, অর্থের লোভে ম্যাচ পাতানো বা ম্যাচ বিষয়ক তথ্য আদানপ্রদান করা। সেটা জাতির সাথে, ক্রিকেট খেলার সাথে অনেক বড় একটা প্রতারণা। সে তুলনায় বল টেম্পারিংয়ের সাথে ব্যক্তিগত কোনো লাভের প্রশ্নই নেই। এটা মূলত দলের স্বার্থে করা একটা ছোট প্রতারণা, যার ক্রিকেটীয় শাস্তি হলো ৫ রান।

স্রেফ স্মিথের স্বীকারোক্তির কারণে একধরনের লোক তথাকথিত ভদ্রতার পক্ষে উন্মত্ত আচরণ করছে। এই অস্ট্রেলিয়ারই ‘মহান’ ক্রিকেটার শেন ওয়ার্ন ফিক্সিং, ড্রাগ কেলেঙ্কারিতেও জড়িয়েছিলেন। সে সময়ও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে এতটা তৎপর মনে দেখা যায়নি।

একটা তরুণকে বাঁচাতে এসে ভিলেন হয়ে যাওয়াকে ট্রাজেডি ছাড়া আর কী বলবেন!

স্মিথ যদি আবার অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কত্ব ফিরে পান, তাহলে ভিন্ন কথা। নইলে ক্রিকেট ইতিহাসে বিরাট এক ট্রাজেডির চরিত্র হয়ে থাকবেন এই স্টিভ স্মিথ।

কোনো সন্দেহ ছাড়াই অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়কত্ব মস্তিষ্ক নিয়ে ক্রিকেটে এসেছিলেন স্মিথ। স্টিভ ওয়াহ, রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্কদের পর এই স্মিথের হাতে বিশ্বকাপ একটা দেখাই যাচ্ছিলো। কিন্তু সেই স্মিথকে সামান্য কারণে নিষেধাজ্ঞায় পড়ে দলের অসহায়তা দেখতে হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরার পর দেখেছেন নেতৃত্বশূন্য এক অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপে আত্মসমর্পন।

স্মিথের শূন্য চেয়ারে হঠাৎই বসতে বাধ্য হওয়া টিম পেইন নিজেই বলেছেন, স্মিথকে আবারও অধিনায়কত্ব ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। সেটা হলে হয়তো স্মিথ একটা শেষ সুযোগনিতে পারবেন। নইলে স্মিথের নাম ওই ছোট তালিকাতেই থেকে যাবে।

যে তালিকায় লেখা থাকে কেবল অভাগাদের নাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link