More

Social Media

Light
Dark

মেজাজী রাজার রাজত্ব

১৯৮৯, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর জন্মশতবর্ষ। বিসিসিআই তার রিলায়েন্স বিশ্বকাপের সাফল্যের পর একার ক্ষমতায় আয়োজন করেছে ছয়দেশীয় লিগ কাম নক আউট টুর্নামেন্ট। ভারত লিগের সেরা হলেও সেমিফাইনালে হেরেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে তখন সেই বিখ্যাত পেস ব্যাটারির একমাত্র মার্শাল অবশিষ্ট, এসে গেছে অ্যামব্রোজ, ওয়ালশ, বিশপ আর উইনস্টন বেঞ্জামিন।

গর্ডন গ্রিনিজ অবসর নেওয়ায় ফিল সিমন্স, বাকি হেইন্স, রিচার্ডসনের সঙ্গে গনগনে আঁচের মতো দাঁড়িয়ে আছেন তদানীন্তন বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান আইজ্যাক ভিভিয়ান আলেকজান্ডার রিচার্ডস। অধিনায়কও তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখনও বিশ্বসেরা। শুধু শেষ দুটো বিশ্বকাপই জেতা হয়নি।

ইডেনের ডি ব্লকের উপর যে কাঠের স্কোরবোর্ডটা থাকত, তাতেই বসত অফিশিয়াল স্কোরাররা। দুজনই জাতীয় স্তরের আম্পায়ার, সমীরণ চক্রবর্তী এবং অতীন্দ্রনাথ সিংহ। তা অতীন্দ্রনাথ সিংহ থাকার সুবাদে আমিও মাঠে যেতাম স্কোরবোর্ডে বসে খেলা দেখতে। কত চেজ করছিল, কে ব্যাট করছিল, এসব গুগল বা ক্রিকইনফো ঘেঁটে দেখে নেওয়াই যায়।

ads

কিন্তু যাই হোক না কেন, চার পেসার আর রিচার্ডস বোলিং-এ। তবু হিসাবের গড়মিলে রিচার্ডস শেষ ওভার করতে গেলেন। আর ওয়াসিম আক্রম একঝাঁক কোঁকড়া চুলে দ্বিতীয় কাঠের স্কোরবোর্ড, যেটি গঙ্গার দিকে বা প্রকৃত ইডেন উদ্যানের দিকে ছিল, সেদিকে রিচার্ডসের শেষ ওভারের পঞ্চম বল ফেলে দিয়ে ছুটে গেলেন কাপ্তান সাহেবের দিকে।

কাপ্তান ইমরান খান দুহাত ছড়িয়ে ব্যাট নিয়ে বিশ্বজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা। একে একে ছুটে আসছেন জাভেদ, রামিজ, কাদির, মুস্তাক, আকিবরা। আম্পায়ার ছিলেন সম্ভবত বিল্টু ঘোষ এবং পিলু রিপোর্টার।

তা সেসব থাক, স্কোরশিট জমা দিতে হবে। ডালমিয়া বোর্ড প্রেসিডেন্ট, আবার সিএবি প্রেসিডেন্টও। লেজার শোয়ের ব্যবস্থা করেছেন। আমরা গুটিগুটি চললাম, ক্লাবহাউসের দিকে। বাবারা কাগজপত্র ফাইনাল করছেন আম্পায়ারস রুমে বসে। আমি চললাম ড্রেসিং রুমের দিকে। মাঠের দিকে মুখ করে বাঁদিকে পাকিস্তানি ড্রেসিংরুম। কিন্তু সে তো খালি, রামিজ, আকরাম রেজা, রিজওয়ানুজ্জামান, সেলিম মালিকরা উদ্দাম ভাংরা করছেন তখন সাইট স্ক্রিনের সামনে। দেখতে দেখতে দেখতে হঠাৎ দেখি ডানদিকের ড্রেসিংরুমটার দরজা খুলছে।

তার বেশ কিছু বছর আগেই আজকাল-এ বোধহয় পড়েছিলাম, সানি গাভাসকার দেবাশিস দত্তকে ডেকে বলছেন, শটপাটের বল দেখবে? বলে পাশে দাঁড়ানো ভিভকে হাতের গুলি ফোলাতে বললেন। আর ধীরে ধীরে মানুষের মাংসপেশি ব্যায়ামাগারের ডাম্বেলে পরিণত হল।

সেই ডাম্বেল, সেই প্রশস্ত ছাতি, সেই ডেলটয়েড, ট্রাইসেপস, সেই ফোরসেপস, শুধুমাত্র তোয়ালে পরিহিত অবস্থায় জিতেন্দ্রর প্রথম ছবি, ‘গীত গায়া পাত্থর নে’ হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। যেন রামকিঙ্কর বেইজ, পাথর কুঁদে মেহনতি মানুষের মুখপত্র বানিয়ে আমাদের ধন্য করে দিলেন। চোখ টকটকে লাল, হারের অপমান নাসাগহ্বর স্ফীত। চিরপরিচিত চুইংগামটা নেই। আমার হাত থেকে পেনটা নিলেন, সই পাইনি।

কারণ হাতের কাছে চার-পাঁচটা অটোগ্রাফ খাতায় আইভিএ রিচার্ডস লিখে দিয়ে চলে গেলেন। পেনটা কাকে দিলেন জানি না, কিন্তু অটোগ্রাফ পাইনি। কিন্তু পেনটা নিয়েছিলেন, ব্যস ওটুকুই। সানি গাভাসকারকে নেতাজি ইনডোরের এক অনুষ্ঠানে ধরেছিলাম ছুটতে ছুটতে।

ভিভ দেননি, কৈশোরের অভিমান পেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ভিভ, কালো মানুষের ভরসা। কালো মানুষের আশার প্রতীক। বর্ণবিদ্বেষের যুগের দক্ষিণ আফ্রিকার ব্ল্যাংক চেক ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। যারা তাঁকে আইডল ভাবে, তাদের সামনে দাঁড়াতে পারবেন না বলে। ভিভ, যুগ যুগ ধরে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসা এক বুনো বাইসন, এক যুগান্তকারী ব্যক্তিত্ব, এক উজ্জ্বল আবেগ।

কী ছিল ভিভের? শুধু ঔদ্ধত্য, শুধুই রিফ্লেক্স, শুধুই ফিটনেস? হাঁটু সোজা করে ঈষৎ ঝুঁকে স্টান্স। ব্যাটটাকে ঠুকছেন পায়ের কাছে, কিন্তু মাটির কষ্ট হচ্ছে না। বোলার বলটা টপ আর্ম অ্যাকশনে ছাড়ল, ভিভ শাফল করলেন।

সামনের পা-টা অফ স্টাম্প বরাবর রাখলেন, ব্যাটটা উঠল, বলটা শর্ট অব গুড লেন্থ, পা পিছনে গেল না বিশেষ, শরীর গেল, তারপরে বহুদিনের টেবলক্লথে পড়ে থাকা মরা মাছি এক ঝটকায় ফেলে দেবার ভঙ্গিতে ব্যাট আড়াআড়ি নেমে এল, মিড উইকেটের ফিল্ডার বল বাইন্ডারির বাইরে থেকে কুড়িয়ে আনতে ছুটল।

অথবা, হাফভলির থেকে সামান্য আগে বল পড়েছে, ব্যাটটা চকিতে নামল। ফলো থ্রুতে হাত কাঁধ অবধিই গেল না, খালি বাঁ হাতের কনুই উঁচিয়ে ডান হাতে ব্যাটটা টেনে দেওয়া হল, ফিল্ডার নড়লও না, দূরে এক্সট্রা কভারের বাইরের দর্শক লাফ দিয়ে মাঠে ঢুকে বাউন্ডারির বাইরে বলটাকে কোনোরকমে ধরলেন, ছুড়ে দিলেন। ঈশ্বর তাঁর আপন তুলি মুছে রাখলেন, রক্তপাতহীন অপারেশনের সমাপন।

তারপর? জমিদারি ঘুরতে দেখার ভঙ্গিতে ভিভ নিতম্ব সামান্য উঁচিয়ে চ্যুইংগাম চিবোতে চিবোতে ব্যাটটাকে লাটের বাটের মতো ঘোরাতে ঘোরাতে ট্রাউজারটা একটু কোমরের কাছে তুলে নিলেন, কলারটাও তুললেন, মাথার কাউন্টি ক্যাপটাকে একটু টেনেটুনে বসিয়ে দিলেন, মুকুটের জায়গায়, চ্যুইংগামের নির্যাসটুকুতে সিঞ্চন করলেন শক্তির উপাসনা। ব্যস এটুকুই। আবার ফিল্ডাররা বাউন্ডারির বাইরে থেকে বল কুড়িয়ে আনার জন্য প্রস্তুত হলেন।

এই ছিল ভিভ রিচার্ডস, বা তাঁর জমিদারি। ৮৩-তে যখন দেখি, রান পাননি বিশেষ। বিশ্বকাপে হেরে যাওয়া লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ স্টিম রোলার চালিয়ে দিল কপিলের ভারতের উপর দিয়ে। ভিভ শুধু ওয়াঙখেড়েতে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করলেন। পরের বারে একমাত্র দিল্লীতে সেঞ্চুরি।

মোটের উপর অভিষেক সিরিজে দিল্লিতে চন্দ্রবিহীন স্পিন আক্রমণকে পিটিয়ে ১৯২ ছাড়া সেরকম বলার মতো ভারতে ইনিংস ছিল না। কিন্তু ইংল্যান্ড? ভিভের খাতায় উপনিবেশকারীদের জন্য বোধহয় আলাদা অধ্যায় রাখা ছিল। দুটি ডবল সেঞ্চুরি সহ আটটি টেস্ট সেঞ্চুরি, সর্বোচ্চ রান ১৯৭৯-এর বিশ্বকাপ ফাইনাল, ১৯৮৪-র সেই অপার্থিব ১৮৯*। কালো মানুষের দাসত্বের প্রতিবাদের জন্য যেন লর্ডস, লিডস, বার্মিংহাম, ওভালের মাঠগুলিকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি।

বিশেষতঃ ১৮৯*। বেয়াল্লিশে পাঁচ একশয় সাত পেরিয়ে একশ ছেষট্টিতে নয়। ভিভ ৯৬*। ইনিংস যখন শেষ হল, ইয়ান টেরেন্স বথামের শেষ বলটা যখন বোলার মাথার উপর দিয়ে ম্যানচেস্টারের গ্যালারিতে উড়ে গেল, তখন ভিভ ১৮৯* আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুশ বাহাত্তরে নয়। কেউ বাদ যাননি। উইলিস, বথাম, ফস্টার, প্রিঙ্গল এবং মিলার। শেষ তিরানব্বই রান আসে মাত্র ষাট বলে। নরসংহার দেখেছিল বিশ্বদর্শক। শতাব্দীর পর শতাব্দীর অবিচারকে এক ঘণ্টায় একাই প্রায় মিটিয়ে দিয়েছিলেন, আইজ্যাক ভিভিয়ান।

হেলমেট পরতেন না তিনি। কেন? অনেকদিন পরে জবাব দিয়েছিলেন, ওই যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নারকেল গাছের ছবি সহ ক্রেস্ট দেওয়া ক্যাপ! যা ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলার সময় আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। তার একটা মান আছে, একটা গর্ব আছে আর আছে সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা। লিলি টমসন, বব উইলিসকে খেলার সময় সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষাই ভিভ রিচার্ডসকে হেলমেটহীন খেলতে বাধ্য করেছে।

শেষের দিকে সম্রাটের ইজ্জতেও কি ঘা লাগেনি? লেগেছে। ভারতের বিরুদ্ধে নরেন্দ্র হিরওয়ানির গুগলি বুঝতে না পেরে আউট। বস্তুত লেগস্পিনে ভিভের একটা দুর্বলতা তো ছিলই। চন্দ্রশেখরকে সামলাতে পেরেছেন সেটা কখনই বলা যাবে না। আবার শেষ সিরিজে ১৯৯১-তে নরমান কাওয়েন্সও টুপিতে আছড়ে ফেলেন বাউন্সার। সেঞ্চুরি ছিল না, শেষ সিরিজে, রিফ্লেক্স কমে আসছিল।

তবু আত্মগরিমাই তাঁকে সহজাত খেলা থেকে বার করতে পারেনি। সচিন পেরেছিলেন, ভিভ পারেননি। অথবা করেননি। বয়স বেড়ে গেলে, সরে যাব, কিন্তু পাকা দাড়িতে সহনায়ক থাকতে পারেননি ভিভ। তাই মাত্র ৮৫৪০ রান নিয়েই মাঠ ছাড়েন। সানি গাভাসকার, অ্যালান বর্ডার, স্টিভ ওয় একে একে ছাড়িয়ে যান তাঁকে। পরবর্তীকালে ব্রায়ান চার্লস লারাও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানের ট্যাগ হয়তো নিজের শার্টের কাঁধে লাগিয়ে নিলেন। কিন্তু ভিভকে ছেড়ে যায়নি তাঁর আত্মসম্মান, প্রখর গরিমাবোধ।

এখনও আছেন ভিভ, রাজার মতো করে রাজার আসনে। হাজার হাজার মানুষ এখনও ভিভকে ক্যালিপসোর সুরে মনে রেখেছে। পেশিশক্তি আর দুরন্ত কবজির মিশেলে, হাই ব্যাকলিফট আর হাই ফলোথ্রুয়ের ওয়েস্ট ইন্ডিয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ভিভ অন্যরকম, অনন্য। প্রতিটি শটে ছিল যাঁর অতীতের দাসত্বের বোঝা ঝেড়ে ফেলার ইঙ্গিত, বর্তমানের সাম্রাজ্য বুঝে নেবার সুর আর ভবিষ্যৎকে পথ দেখাবার স্বপ্ন।

আইজ্যাক ভিভিয়ান, আলেকজান্ডারের মতোই বিশ্বজয় করেছিলেন, মুকুট ছাড়াই, অলিভের পাতা মাথায় বেঁধে। আইজ্যাক ভিভিয়ান আলেকজান্ডার বিজিত ইংল্যান্ডেরই আর-এক রিচার্ড দ্য লায়নহার্টের মতোই সিংহের হৃদয় নিয়ে এখনও আমাদের মতো আপামর জনসাধারণের মনে শাসন করে চলেন। আসলে মেজাজটাই তো আসল রাজা।

সেই গল্পটা দিয়ে শেষ করি, যেখানে, গ্রেগ টমাস, গ্ল্যামারগনের হয়ে সামারসেটের ভিভকে বেশ কয়েকবার চমকেছেন। স্যাঁতসেঁতে উইকেট, নতুন বল তো একটু গল্প করবেই। তা বলে ভিভকে চমকানো! বোলারের কলার তো উঠবেই। ভিভকে ডেকে টমাস বললেন, ‘জানো তো, বলটা লাল আর ছটা সেলাই আছে!’ পরের ওভারেই বোলারের কানের পাস দিয়ে বল উড়ে গেল সীমানার বাইরে, ঝোপঝাড়ে। এবারে ভিভের পালা, টমাসকে ডেকে বললেন, ‘বলটা কেমন দেখতে জানো তো! যাও খুঁজে আনো!’ ঔদ্ধত্য না কালো মানুষের স্বপ্ন? কলার না শিরদাঁড়া?

বোলারকে খাদ্য মনে করা শক্ত লাল চোখের খাড়া নাকের মানুষটা আজও আমাদের হৃদয়পুরী আলো করে বসে আছে। মাঝে মাঝে নামেন বটে মাঠে, তখন আমাদেরও নামতে হয়, বাউন্ডারি থেকে বল কুড়িয়ে হতভাগ্য বোলারকে ছুড়ে সিংহের মুখে ফেলার জন্য। আইজ্যাক ভিভিয়ান আলেকজান্ডার রিচার্ডস জনগণের সম্রাট, মুকুটটা তো পড়েই আছে, তবে রাজাও আছে ওই হৃদয়জোড়া আলপথে। কালো সাদা বাদামি সব গুণমুগ্ধের বুকে আজও বৃষ্টি নামান তিনি।

কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link