More

Social Media

Light
Dark

ডনকে ছোয়া কঠিন নয়, অসম্ভব!

১৯৪৭-৪৮ মৌসুমে ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফর। সিডনি টেস্টে বিল ব্রাউনকে নন-স্ট্রাইক প্রান্তে রানআউট করে বেশ হৈচৈ ফেলে দিলেন ভারতের ভিনু মানকড়। এর আগে এমন অদ্ভুতুড়ে রানআউট টেস্ট ক্রিকেট তথা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কখনো দেখা যায়নি। ভিনু মানকড় মূলত এই প্রকার আউটের জনক বিধায় ক্রিকেটীয় পরিভাষায় এর নামই হয়ে যায় ‘মানকাডিং’।

মানকাডিং ক্রিকেটপাড়ায় বহুল পরিচিত শব্দ। মানকাডিংয়ের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ক্রিকেটার ও বিশ্লেষকদের মধ্যে প্রায়ই দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এইতো ক’দিন আগেও রিকি পন্টিং আর রবিচন্দ্রন অশ্বিন তাদের পরস্পর বিপরীত অবস্থানের কথা জানালেন।

এতসব কিছুর পরেও ‘মানকাডিং’ শব্দটা ইংরেজি ভাষায় কিন্তু গৃহীত হয়নি।

ads

তবে একজন ক্রিকেটার আছেন, যার নামযুক্ত বিশেষণ ঠিকই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। আর ভণিতা না করে বলেই দিই, তিনি স্যার ডন ব্র‍্যাডম্যান৷ দুনিয়ার জনপ্রিয়তম ক্রিকেটার, অবশ্যই ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান।

Collins English Dictionary তে অন্তর্ভুক্ত শব্দটা হচ্ছে ‘Bradmanesque’, মানেটা তুলে দিচ্ছি সেখান থেকেই – ‘A batsman or an innings reminiscent of Sir Don Bradman in terms of dominance over the opposing bowlers.’

কিন্তু যার নাম নিয়ে ইংরেজি ভাষায় শব্দ পর্যন্ত এসে গেল, যদি বলি সেই ব্র‍্যাডম্যান নামটাই এসেছে ভুলবশত?

ডনের পূর্বপুরুষ এমানুয়েল দানেরোর জন্ম ইতালির জেনোয়ায়। উনিশ বছর বয়সে তিনি ঠিক করেন যে, হল্যান্ডে পাড়ি জমাবেন। পথিমধ্যে থামলেন অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়া দাগ কেটে গেল দানেরোর মনে। ঠিক করলেন, এখানেই থেকে যাবেন।

একাধিক বিয়ে করার পরেও বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল দানেরোর। সেই আলোচনা থাক। ডনকে নিয়ে লিখতে গিয়ে এসব কথা লিখলে নির্ঘাৎ কপালে গালাগালি জুটবে!

যাহোক, সে সূত্রে ডনের প্রপিতামহ-পিতামহী ছিলেন জন ও লুসি ব্র‍্যাডনাম। না না, আপনি ঠিকই পড়েছেন। জন ও লুসি- দু’জনেরই মারা যাবার পর তাদের নাম দাখিল করা হয়েছিল ব্র‍্যাডনাম হিসেবে।

তবে তাঁদের ছেলে, অর্থাৎ চার্লসের নাম কেন ব্র‍্যাডনামের বদলে ব্র‍্যাডম্যান রাখা হয়েছিল?

চার্লস উইলিয়ামসের ‘ব্র‍্যাডম্যান’ বইতে এর ব্যাখ্যা এরকম, ‘গ্রামাঞ্চলে অল্পশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষ তাদের সন্তানদের নাম-পরিচয় দাখিল করাতে গিয়ে প্রায়ই ভুল করত। চার্চগুলোও প্রায়ই এরকম ভুল নাম-পরিচয় উঠিয়ে রাখত।’

চার্লস ব্র‍্যাডম্যান বিয়ে করেন এলিজাবেথ বিফিনকে, যাদের ঘরে জন্ম হয় জর্জ ব্র‍্যাডম্যানের। জর্জ ব্র‍্যাডম্যান সম্পর্কে ডন ব্র‍্যাডম্যানের বাবা।

বংশগত নাম বদলে ফেলার দৃষ্টান্ত এই শেষ নয় ব্র‍্যাডম্যান পরিবারে। ডন ব্র‍্যাডম্যানের নিজের ছেলে ডন অযাচিত মনোযোগ এড়াতে নিজের নাম পাল্টে করে ফেলেছিলেন ‘জন ব্র‍্যাডসেন’! যদিও পরে আবার ব্র‍্যাডম্যানেই ফিরেছিলেন।

৫২ টেস্ট, ২৯ শতক, ১২ দ্বিশতক, ৯৯.৯৪ গড়- ডনের ব্যাটিং নিয়ে দিস্তার পর দিস্তা লিখে ফেললেও কম হয়ে যাবে। ক্রিকেটের অন্য দিকগুলোয় যে অভিজ্ঞতা হয়নি তা কিন্তু নয়। লেগস্পিনটা করতেন, টেস্টে দুটো উইকেটও আছে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কিন্তু উইকেটও সামলেছেন ডন।

১৯৩৮-৩৯ মৌসুমে দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন। অবশ্য তার ফর্ম পড়তির দিকে ছিল না কখনোই। কিন্তু তারপরও কিছু সময় থাকে, যেটা আলাদা করে বলার মত। ঐ মৌসুমটাও সেরকম। স্কোরগুলো দেখুন- ১১৮, ১৪৩, ২২৫, ১০৭, ১৮৬, ১৩৫*!

মৌসুমের শেষদিকেই এক ম্যাচে নিউ সাউথ ওয়েলসের বিপক্ষে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন ডন। প্রথম ইনিংসে ক্ল্যারি গ্রিমেটের বলে অ্যালবার্ট চিথামের ক্যাচও নিয়েছিলেন।

তবে উইকেটকিপিংটা বাড়তি দায়িত্ব হিসেবেই এসেছিল হয়ত, পরের তিন ইনিংসে ব্যর্থ হলেন ডন। করলেন ৫, ৭৬ ও ৬৪। মোটেই খারাপ স্কোর নয়, তবে ডনের জন্য তো গড়পড়তাও নয়!

গ্লাভস ছাড়ার পরের তিন ইনিংসে অবশ্য পুষিয়ে দিয়েছিলেন। স্কোরগুলো দেখুন- ২৫১*, ১৩৮ ও ২৬৭!

ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং, উইকেটকিপিং তো হলো। বাকি রইল ম্যাচ পরিচালনা। এটা ঠিক হয়ে না উঠলেও লাইসেন্সটা কিন্তু ছিল। ১৯৩৩ এর আগস্টে নিউ সাউথ ওয়েলস ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের আম্পায়ারিং পরীক্ষায় উতরে গেলেও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আম্পায়ারিং হ্যাটটা মাথায় তোলেননি।

ব্র‍্যাডম্যান তার শেষ ক্রিকেট ম্যাচ খেলেন ১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ক্যানবেরার মানুকা ওভালে পূর্ণশক্তির এমসিসি দলের বিপক্ষে খেলেন অস্ট্রেলিয়া প্রধানমন্ত্রী একাদশের হয়ে৷ এমসিসির অধিনায়ক টেড ডেক্সটার ২৫৩/৭ রানে ইনিংস ঘোষণা করেন। পাঁচ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ক্রিজে যোগ দেন রাজনীতিবিদ ডন চিপের সাথে৷ এমসিসির খেলোয়াড়দের করতালি আর দর্শকদের হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে ডন ব্র‍্যাডম্যান যখন মাঠে প্রবেশ করেন, ডন চিপের আর বোঝার বাকি ছিল না যে কে ‘আসল ডন’!

সেই ম্যাচে ব্রায়ান স্ট্যাথামের বলে আউট হন ডন ব্র‍্যাডম্যান। ওল্ড ট্রাফোর্ডের একটা বোলিং প্রান্ত কিন্তু ব্রায়ান স্ট্যাথামের নামে৷ অপরটি জিমি অ্যান্ডারসনের নামে।

ব্র‍্যাডম্যানকে অনন্যভাবে ধারণ করা হয়েছে সংস্কৃতিতে। সিনেমায় তো হাজির হয়েছেন সশরীরেই, বই, গান, জাদুঘর কী নেই তার সম্মানে। এমনকি আছে ফুলও। ২০০২ সালে মেইল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল এক জাতের হাইব্রিড টি রোজ উৎপাদন করে। যার নাম ‘স্যার ডোনাল্ড ব্র‍্যাডম্যান টি রোজ’।

ডনের নব্বইতম জন্মদিনে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন শচীন টেন্ডুলকার ও শেন ওয়ার্ন। শচীন ডনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আচ্ছা, এখনকার দিনে খেললে আপনার গড় কত হতো?’

একটু ভেবে ডন উত্তর দিলেন, ‘হয়তো ৭০..’

শচীন জানতে চাইলেন, ‘৭০ কেন? ৯৯ কেন নয়?’

সহাস্যে ডন জবাব দিলেন, ‘নব্বই বছরের বুড়োর জন্যে ৭০ গড় তো খারাপ নয়!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link