More

Social Media

Light
Dark

জ্যাক অব অল ট্রেডস

অলরাউন্ডার কারে কয় ? অলরাউন্ডার মানে কী জ্যাক অব অল ট্রেডস, মাস্টার অফ নান? কিন্তু সেই জ্যাকই যদি সকল বিষয়ের মাস্টার হন তাহলে তো তাঁকে অলরাউন্ডারদেরই মাস্টারমশাই বলা যেতে পারে, নয় কী? হ্যাঁ, এমনই একজন জ্যাক হলেন জ্যাক হেনরি ক্যালিস, তর্ক-সাপেক্ষে সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার, যিনি তাঁর ক্যারিয়ার ১৯৯৫ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে অলরাউন্ডারদের মাস্টার মশাইই বটে।

ব্যাট হাতে যখন নেমেছেন শচীন, লারা, পন্টিং, দ্রাবিড়, স্টিভ ওয়া, ইনজামামদের সাথে এক সূত্রে উচ্চারিত হয়েছে তাঁর নাম। আবার যখন অধিনায়ক হিসেবে কখনো হ্যান্সি ক্রোনিয়ে, কখনো শন পোলক বা গ্রেম স্মিথরা তাঁর হাতে বল তুলে দিয়েছেন সেই আস্থার প্রতিদান দিতে কোনদিনই ভুল হয়নি জ্যাক হেনরি ক্যালিসের।

গ্যারি সোবার্স, ইমরান খান, ইয়ান বোথাম, কপিল দেব, রিচার্ড হ্যাডলিদের মতো অলরাউন্ডার দের সাথে একাসনে বসার জন্য ক্যালিস কী কোনো অংশেই কম ছিলেন? বোধহয় না, পরিসংখ্যান যদি গাধা না হয়, তাহলে সেটা অবশ্যই ক্যালিসের হয়েই কথা বলবে। ক্যালিসের পরিসংখ্যানের দিকে একবার তাকান। ১৬৬ টেস্টে ৫৫.৩৭ গড়ে ১৩২৮৯ রান, ৪৫টা সেঞ্চুরি, ৫৮টা হাফ সেঞ্চুরি, বল হাতে উইকেট সংখ্যা ২৯২ টা। এর সাথে যোগ করুন ৩২৮ ওয়ানডেতে ৪৪.৩৬ গড়ে ১১৫৭৯ রান, ১৭টা সেঞ্চুরির সাথে ৮৬টা হাফ সেঞ্চুরি, বল হাতে এবারে ২৭৩টা উইকেট।

ads

তাহলে ক্যালিস মানে কী শুধুই পরিসংখ্যানের কচকচানি? না, ক্যালিস মানে প্রায় দেড় যুগ সময় ধরে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের একটা বট গাছ। যার চওড়া কাঁধ বহুসময় ভরসা জুগিয়ে গিয়েছে দলের, তরুণদের কাছে যিনি হয়ে ওঠেন অনুপ্রেরণা আর রোল মডেল। ক্রিকেট শিক্ষার্থী যাঁকে দেখে বলে ওঠে ‘আমিও জ্যাক ক্যালিস হতে চাই।’ তিনিই ক্যালিস যার বিকল্প কেন তাঁর অর্ধেক ও এখনো পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটে বিরল।

কেমন ছিলেন আসলে ক্যালিস? টেস্ট ম্যাচ বাঁচাতে হবে পঞ্চম দিনের পিচে, সেখানেও ক্যালিস আছেন, প্রমাণ – অস্ট্রেলিয়াতে মেলবোর্ন টেস্টে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে ওয়ার্ন-ম্যাকগ্রা দের বিরুদ্ধে ২৭৯ বলে ১০১ রানের অমর ইনিংস, আবার টেস্টে দলের প্রধান বোলার পোলক অনুপস্থিত, বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে, সেখানেও ক্যালিস অনন্য, প্রমাণ – ২০০৩ সালের হেডিংলি টেস্টে ইংল্যান্ডের দারুন ব্যাটিং লাইন আপকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ৫৪ রানে ৬ উইকেট নেওয়া।

আবার একদিনের ক্রিকেটের মহারথীদের মধ্যে যদি শচীন, মার্ক ওয়া, বেভান, কোহলি, ডোনাল্ড, জয়াসুরিয়া, রিচার্ডস দের নাম করেন, সেখানেও ক্যালিস কিন্তু ঠিক ততটাই দামি। ঢাকায় মিনি বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি কিংবা ফাইনালে বল হাতে ৫ উইকেট নিয়ে জেতানো, আর কী চাই!

তবে হ্যাঁ, এটাও ঠিক ঢাকার ঐ টুর্নামেন্ট বাদ দিলে বড় টুর্নামেন্টে তিনি ঠিকই ভালো খেলতেন, কিন্তু দৃষ্টিকটু ভাবে সেমি ফাইনাল বা বহু বড় ম্যাচে নিজের সেরা টুকু দিতে পারেননি, সে ’৯৯ বিশ্বকাপে এজবাস্টনের সেমি ফাইনালই ধরুন, হাফ সেঞ্চুরি করলেও ম্যাচে জিতিয়ে আসতে পারেননি কিংবা ২০০৭ বিশ্বকাপের সেমি ফাইনাল হোক, সেখানেও চরম ব্যর্থ। এমনকি ঘরের মাঠে ২০০৩ বিশ্বকাপেও তেমন ভাবে আলো ফোটাতে পারেননিই বলা চলে ক্যালিসকে। আর এখানেই যেন ক্যালিসের পারফরমেন্স এর সাথে বড় ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার হতাশাও ঠিক সমার্থক হয়ে যায়।

তবে এই হতাশাকে দূরে সরিয়ে রাখলে বছরের পর বছর ধরে জ্যাক ক্যালিস নামটা কিন্তু বিশ্ব ক্রিকেটে এক বিরাট আলোরই নাম। দুই ধরণের ক্রিকেট মিলিয়ে ২৫ হাজারের ও বেশি রানের পাহাড় যখন গড়েছেন। ব্রায়ান লারা, শচীন টেন্ডুলকার, রিকি পন্টিং, রাহুল দ্রাবিড়, ইনজামাম উল হকদের মতো সমসাময়িক গ্রেটদের সাথে বাইশ গজের টক্কর সত্যিই এক বিরাট উপভোগ্য বিষয় ছিল।

যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিংয়ে ক্যালিস মানে ধ্রুপদী ঘরানার চোখ জুড়ানো ব্যাটিং, যেখানে ব্যাটিংয়ের চার নম্বর পজিশনটাকে নিজের করে নেওয়া ভদ্রলোকের একটা কবিতা লেখা কভার ড্রাইভ দেখার জন্য বোধহয় কয়েক মাইল হাঁটাও যায়। যার জিব্রাল্টার রকের মতো সলিড টেকনিক দেখে মনে হয় ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, কার্টলি আম্ব্রোস, গ্লেন ম্যাকগ্রা, ব্রেট লি, শেন বন্ডদের ফাস্ট বোলিং ঐ পাথরে ধাক্কা খেয়েই ফিরে আসতে বাধ্য।

শেন ওয়ার্ন, মুত্তিয়া মুরালিধরণ বা অনিল কুম্বলের মতো বিশ্বমানের স্পিনারদের বিরুদ্ধে যদিও ক্যালিসের সফলতার হার তুলনায় যথেষ্ট কম, তবুও স্পিন খেলার টেম্পারেমেন্ট এ সমসাময়িক বহু ব্যাটসম্যানের থেকে তিনি খুব পিছিয়ে থাকবেন বলে মনে হয় না।ইনসাইড আউট করে স্পিনারকে মারা লফটেড শট আজও ক্রিকেটের অন্যতম সেরা দৃশ্য।

না হলে সব মিলিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে শচীন, লারা বা পন্টিংদের থেকেও বেশি গড় নিয়ে কিংবা টেস্ট ক্রিকেটে সর্বাধিক ম্যাচ সেরার পুরস্কার নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করা বোধহয় সম্ভব হতো না। ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে যেমন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বেশ নড়বড়ে ছিলেন, যত সময় এগিয়েছে ততই টেস্ট বা একদিনের ক্রিকেটে চওড়া হয়েছে ক্যালিসের ব্যাট।

ডারবানে ভারতের বিরুদ্ধে জীবনের শেষ টেস্টের আগে গ্রেম স্মিথদের বোধহয় আবদার ছিল ক্যালিসের কাছে – ‘যাও গো এবার যাওয়ার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও…’। কথা রেখেছিলেন ক্যালিস, অনবদ্য শতরান উপহার দিয়ে বাইশ গজে বিদায় বেলাকে সত্যিই রাঙিয়ে দিয়ে যান।

ব্যাটসম্যান ক্যালিস আসলে এতটাই জায়গা জুড়ে বিশ্ব ক্রিকেটে বিরাজ করেছেন দীর্ঘদিন সেখানে কোথাও গিয়ে যেন দুর্দান্ত ফিল্ডার ও তাঁর থার্ড বা ফোর্থ সিমারের সত্ত্বাটা ঢাকা পড়ে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকা দল এমনিতে বরাবরই ফিল্ডিংয়ে অনবদ্য, সেখানে স্লিপ ফিল্ডার হিসেবে ক্যালিসের বিশ্বস্ত হাত একটা বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে চিরকাল।

আর বোলিং এর প্রসঙ্গ এলে একগাদা দারুণ সব অলরাউন্ডারে ঠাসা দক্ষিণ আফ্রিকা দলে ক্যালিস যদি শুধু বোলার হিসেবেও খেলতেন তাতেও বোধহয় তাঁর দলে জায়গা পাওয়া আটকাতো না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাড়ে ৫০০র বেশি উইকেট কিন্তু অনেক নামী দামি বোলারের ও অ্যাকাউন্টে নেই, সেখানে ক্যালিসকে ব্যাটিং এর স্তম্ভ হয়েও থাকতে হয়েছে বছরের পর বছর। মূলত: হিট অফ দ্য ডেক বোলার হলেও একই লাইনে টানা বল করে যাওয়া, চকিতে দেওয়া এক একটা বাউন্সার বা স্লোয়ারের ভ্যারিয়েশন বোলার ক্যালিসকে ও এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে বরাবরই।

শুরু করেছিলাম ক্যালিসকে অলরাউন্ডার দের মাস্টার মশাই বলে, এটা সত্যিই ক্যালিস যে সোনালি সময়ে বাইশ গজে বিরাজ করেছেন সে সময়ে তাঁর থেকে বড় অলরাউন্ডার কেউই ছিলেন না, স্বদেশীয় ল্যান্স ক্লুজনার বা শন পোলকরা অবশ্যই দারুন অলরাউন্ডার ছিলেন, ইংল্যান্ডে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের মত তারকা, নিউজিল্যান্ডে ক্রিস কেয়ার্নস ছিলেন, শ্রীলঙ্কায় জয়াসুরিয়া বা পাকিস্তানে আব্দুল রাজ্জাক ছিলেন, কিন্তু ক্যালিস সব দিক থেকে সোনায় মোড়া ধারাবাহিক পারফরমেন্সের বিচারে খানিকটা এগিয়েই থেকেছেন বরাবরই।

ধৈর্য, দৃঢ়তা, হার না মানা মানসিকতা আর দুর্দান্ত টেকনিক তাঁকে নিয়ে গিয়েছে এক অন্য স্তরে। সাধে কী আর রাহুল দ্রাবিড়ের মতো কেউ বলেন ‘ক্যালিস হলো আমাদের সময়কার সোবার্স’, কিংবদন্তি হওয়ার জন্য এটুকুই তো বোধহয় যথেষ্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link