More

Social Media

Light
Dark

মরিনহোর টটেনহ্যাম অধ্যায়

ফুটবল বিশ্ব তখন থমকে আছে ইউরোপিয়ান সুপার লিগ নিয়ে।

সকলে যখন ভাবছে কী হবে ফুটবলের ভবিষ্যৎ তখনই এক চাল চাললো টটেনহ্যাম হটস্পার। হুট করে কথা নেই বার্তা নেই একদিন সকালে উঠে সকলে আবিষ্কার করলেন চতুর্থবারের মতন বরখাস্ত হয়েছেন হোসে মরিনহো। তাও যখন টটেনহ্যামকে শিরোপা জেতানোর দ্বারপ্রান্তে, লিগ কাপের ফাইনালের মাত্র ৫ দিন আগে।

প্রায় ৩০ মিলিয়ন ইউরো গচ্চা দিয়ে মরিনহোকে বিদায় বলেছে টটেনহ্যাম। শুধু তাই নয়, টটেনহ্যামের চাকরি ছাড়ার এক মাসের মাথাতেই নতুন চাকরি জুটিয়ে ফেলেছেন জোসে মোরিনহো। নিজের বাক্স-বোচকা নিয়ে তিনি ছুটছেন ইতালিতে। রোমার নতুন মালিক তাদের নতুন পথে দেখানোর জন্য বেছে নিয়েছেন মরিনহোকে। রোমার নতুন চাকরিতে পা দেওয়ার আগে দেখে আসা যাক কেমন ছিল হোসের টটেনহ্যাম অধ্যায়।

ads

মরিনহোর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল সেরা কিন্তু এক ভঙ্গুর টটেনহ্যাম। সেরা কিন্তু ভঙ্গুর বলতে হচ্ছে কারণ একদিক দিয়ে টটেনহ্যামের মতন পারফেক্ট দল সেসময় খুব কমই ছিল। মাউরিসিও পচেত্তিনোর অধীনে ৫ বছরে বলতে গেলে বড় কোনো ট্রান্সফার ছাড়াই টটেনহ্যাম হয়ে উঠেছিল ইংলিশ এবং ইউরোপিয়ান ফুটবলের ভীতিজাগানিয়া একটি দল। কিন্তু সেই পারফেক্ট দলটার মোর‍্যাল ছিল বেশ ভঙ্গুর, হবেই বা না কেন?

পাঁচ বছর ধরে প্রতি মৌসুমে ভালো করার পরেও যখন দলের খেলোয়াড়েরা কোনো শিরোপা পান না, তখন খেলোয়ারদের নিজেদের মধ্যেই প্রশ্ন জাগে। ফলে নতুন দলে গিয়ে শিরোপার খোঁজ করাটাও দোষের কিছু নয়। আগের মৌসুমে লিভারপুলের কাছে এক বোরিং ফাইনাল হেরে দলের প্রতিটি খেলোয়াড় ভেঙ্গে পড়েছিল মানসিকভাবে। আর নতুন কোনো খেলোয়াড়ের সংযোজন না হওয়া আরো ভেঙে দিয়েছিল টটেনহ্যামকে।

ফলে আগের লো মোর‍্যাল টিমকে নিয়ে আর কম্বিনেশন খুঁজে পাচ্ছিলেন না মাউরিসিও পচেত্তিনো। তাই ক্লাবকে লিগগ টেবিলে ১৪তম অবস্থানে রেখে বিদায় নেন পচেত্তিনো। বাজেট সংকটের মাঝেও স্পার্সকে প্রিমিয়ার লিগের সেরাদের কাতারে টিকিয়ে রাখার পেছনে পচেত্তিনোর অনস্বীকার্য। আর সেসময়ই দেবদূত হয়ে ভিড়েছিলেন জোসে মোরিনহো।

যতই লোকে বলুক না কেন মোরিনহো তার সেরা সময়টা হারিয়েছেন, যেখানেই গিয়েছেন শিরোপা না জিতিয়ে ফিরেননি তিনি। টটেনহ্যামের মতন দলকে, প্রিমিয়ার লিগে যারা ‘বটলার’ হিসেবে পরিচিত, তাদেরকে যদি কেউ জেতাতে পারেন তবে সেটা মোরিনহোই। আর তার উপরে তাদের ইউরোপ জেতার আকাঙ্খা পকেটও ভারী করেছিল মোরিনহোর। ফলে চাইলেই যে কাউকে কিনতে পারার স্বাধীনতাও ছিল তাঁর কাছে।

মরিনহো যখন দায়িত্ব নেন তখন টটেনহ্যামের অবস্থান লিগ টেবিলে অবস্থান ১২তম। তার উপর দায়িত্ব নিতে না নিতেই হ্যারি কেইনের ভয়ঙ্কর ইনজুরি। পুরো মৌসুমের জন্য বাদ। তার উপর ভেঙে পড়া খেলোয়াড়েরা, এরিকসেন দল ছাড়ার জন্য প্রতিদিন নোটিশ দিয়েই যাচ্ছেন। সবমিলিয়ে মোরিনহোর শুরুটা ছিল ভয়ঙ্কর। কিন্তু নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে যেই দলকে একটু স্বাভাবিক করে তুললেন, সেই আঘাত হানলো বেরসিক করোনা ভাইরাস। ফলে সবকিছু বন্ধ করে বাড়িতে থাকা শুরু সকলের।

তবে মরিনহোর জন্য এই তিন মাসের ছুটি ছিল মন্দের ভালো। তিন মাসের ছুটিতে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেন হ্যারি কেইন। আর তার উপরে ভর করেই ষষ্ঠ অবস্থানে থেকে ইউরোপা লীগে জায়গা নিশ্চিত করে টটেনহ্যাম। এরপর মোরিনহো নিজেই বলেছেন, ‘জীবনে কখনও ভাবিনি যে ইউরোপা লিগে সুযোগ পেয়ে এত আনন্দ করবো আমি।’

সবার সেরা সময়টা সবসময় থাকেন না মরিনহোও সেটা বুঝেছেন। তাই অবশেষে যখন সামার ট্রান্সফার উইন্ডো আসল, তখনই ঝোপ বুঝে কোপ মারতে শুরু করলেন মরিনহো। এমনিতেই এটা তার দ্বিতীয় মৌসুমে। কোনো ক্লাবে মোরিনহোর দ্বিতীয় মৌসুম মানেই সেই ক্লাবের জন্য তার সেরা পারফরম্যান্স।

ম্যাট ডোহার্টি, জো হার্ট, হোজবার্গ, সার্জিও রেগুলিয়নের মতন খেলোয়াড়কে ভেড়ান দলে। কিন্তু অনেক চেষ্ট করেও নিজের ডিফেন্সে আরেকজন খেলোয়াড় আনতে পারেননি মরিনহো। আগের মৌসুমে দেয়াল হয়ে দাঁড়ানো ইয়ান ভার্তোনেকে হারিয়েছেন মরিনহো। ফলে সে জায়গায় আরো একজন ডিফেন্ডার দরকার ছিল মোরিনহোর। তা ছাড়াই মৌসুম শুরু করতে হয় তাকে।

যদিও শেষদিকে এসে লেভি রিয়াল থেকে লোনে নিয়ে আসেন ঘরের তারকা গ্যারেথ বেলকে। রিয়ালে থাকতে এই বেলকে কেনার কম চেষ্টা করেননি মোরিনহো। শেষমেশ বেল যখন রিয়ালে এসেছিলেন, ততদিনে রিয়ালের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছেন মোরিনহো। এক মৌসুমে ৬৫ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করার পর ভালো কিছু আশা করেছিল টটেনহ্যাম বোর্ড। দর্শকও অপেক্ষায় ছিল দ্বিতীয় মৌসুমে মরিনহো জাদু দেখতে।

মরিনহোর শুরুটাও হয়েছিল মরিনহোর মতন করেই। মৌসুমের প্রথম ম্যাচে আনচেলত্তির বিপক্ষে পরাস্ত হলেও পরের ম্যাচ থেকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল টটেনহ্যাম। নিজের আগের ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে তাদেরই মাটিয়ে ৬-১ গোলে হারিয়ে এক মধুর প্রতিশোধ নিয়ে ফিরেছিলেন তিনি। নভেম্বরের শেষদিকে এসে লিগের প্রথম অবস্থানটাও কব্জা করে নেন মরিনহো। কিন্তু ক্রিসমাসের আগের সপ্তাহে এসেই পা হড়কান মরিনহো, ক্লপের বিপক্ষে।

লিভারপুলের বিপক্ষে ফিরমিনোর শেষ মিনিটের গোল থেকেই শুরু হয় টটেনহ্যামের উলটো যাত্রা। আর সে যাত্রা চলে মোরিনহোর ক্লাবে শেষদিন পর্যন্ত। প্রথম ১২ রাউন্ডে মাত্র ১ হারের দেখা পাওয়া টটেনহ্যাম পরের ১৯ রাউন্ডে ৯ রাউন্ডই মাঠ ছাড়ে হার নিয়ে।

মোরিনহো এমনিতে ডিফেন্সিভ মাইন্ড সেটাপে খেলতে বেশি পছন্দ করেন। এছাড়াও প্রতি ম্যাচে তার খেলার ধরণ পাল্টায় প্রতিপক্ষের খেলায় ধরণের উপর। কিন্তু পচেত্তিনোর আমলে সবসময় অ্যাটাকিং ফুটবল খেলে এসেছে দল। আর তাদের একটা নির্দিষ্ট ধরাবাঁধা ট্যাক্টিসও ছিল। কিন্তু এই মৌসুমে এসে এরকম ফ্লুইড ট্যাক্টিসে ঠিক মানাতে পারছিলেন না খেলোয়াড়েরা। ফলে শেষদিকে গোল খেয়ে হারতে হয়েছে অনেক ম্যাচ। মরিনহোর মতন ঠোঁটকাটা কোচ তখন খেলোয়াড়দের সমালোচনা করতেও ছাড়তেন না, ফলে খেলোয়াড়দের অনাস্থা আস্তে আস্তে জমা হচ্ছিল।

আর তার সাথে যোগ হয়েছিল মরিনহোর সহকারীর বিদায়। মরিনহোর কোচিং ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তার সাথে কাজ করে গিয়েছেন রুই ফারিয়া। পোর্তো থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, মরিনহোর পথের সাথী ছিলেন তিনি। কিন্তু টটেনহ্যামে যোগ দেওয়ার আগে আগে নিজের কোচিং ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ করতে কাতারি ক্লাবে যোগ দেন তিনি।

ফলে তাকে ছাড়াই পথচলা শুরু করতে হয় জোসেকে। আর তার পরিবর্তে আসা জো সাক্রেমেন্টো ঠিক মানিয়ে নিতে পারেননি মরিনহোর সাথে। শুধু তার সাথে নয়, খেলোয়াড়দের সাথেও। ফলে খেলোয়াড়দের সাথে তার বিবাদ তৈরি হয়েছে কয়েক মাসেই।

এর মধ্যেও ঠিকই নক-আউট টুর্নামেন্টে টটেনহ্যামকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন জোসে। কারাবাও কাপের ফাইনালে তুলেছিলেন নিজের দলকে। এফএ কাপের এক্সট্রা টাইমে গিয়ে ডিফেন্ডার ভুল না করে বসলে হয়তো সেখানেও নিজের খেল দেখাতে পারতেন মরিনহো। আর ইউরোপা লিগে ডায়নামো জাগরেভের বিপক্ষে হারের কথা তো না বললেই নয়, পুরো ম্যাচে খুঁজেই পাওয়া যায়নি টটেনহ্যামকে। ২ গোলের লিডে নিজেদের ডিফেন্স উন্মুক্ত করে দিয়ে নিজেদের সেরা সুযোগ নিজেরাই হারিয়েছে তাঁরা।

তবুও এত বছর ধরে শিরোপার অপেক্ষা করা টটেনহ্যাম শেষ সুযোগ পেয়েছিল কারাবাও কাঁপে। পেপ গার্দিওলাকে হারাতে জোসে মরিনহোর থেকে ভালো অস্ত্র আর কেই বা হতে পারে? আর তাকেই কীনা ফাইনালের ৫ দিন আগে বরখাস্ত করলেন টটেনহ্যাম বোর্ড।

নিজেদের শিরোপা জেতার আরেকটি সুযোগ হেলায় হারালেন কিংবা সমর্থকদের ভাষায় ‘বোটল’ করলেন আরেকটি শিরোপা। আর মরিনহো তাঁর ক্যারিয়ারের আরেকটি কোচিং যাত্রা শেষ করলেন তিক্ততা দিয়ে, বোর্ড আর খেলোয়াড়দের আস্থা হারিয়ে।

শেষ ২০১২ সালে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে ড্রেসিংরুম হারিয়ে ভালোভাবে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি, আর ড্রেসিংরুমে সম্মান রেখে বের হওয়ার ঘটনা ২০১০ সালে ইন্টারের ডাগ-আউটে। এরপর থেকে যেন নতুন যুগের সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ মরিনহো।

ভালো ফলাফল, শিরোপা আনতে পারলেও ড্রেসিংরুম হারানো তার নিত্যনৈমিত্যিক ব্যাপার। আর এর মাঝেই এএস রোমার দায়িত্ব নিয়েছেন মরিনহো। আধুনিক ফুটবলে এসে আবারও কী নিজেকে সেরা প্রমাণ করতে পারবেন মরিনহো? প্রশ্নটা তাঁর কাছে গোটা বিশ্বের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link