More

Social Media

Light
Dark

‘অশচীন’সুলভ অধিনায়কত্ব!

‘আ ক্যাপ্টেন ইজ অ্যাজ গুড অ্যাজ হিজ টিম’ – সত্যি কি তাই? অধিনায়ক শচীন টেন্ডুলকারকে দেখলে আপনি সম্পূর্ন রূপে অবাক হয়ে যাবেন এই সিদ্ধান্তে আসার আগে।

দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ এবং বিলেতে সিরিজ হার অধিনায়কত্বের মুকুট কেড়ে নেয় ব্যক্তিগত সমস্যায় জর্জরিত, অফ ফর্মে থাকা মোহাম্মদ আজহারউদ্দীনের। আর সেখান থেকেই জন্ম অধিনায়ক শচীনের। কেমন অধিনায়ক ছিলেন তিনি? যদি স্কোরবোর্ডকে সূচক মানেন তবে অবশ্যই ভীষন খারাপ। কিন্তু সত্যি কি তাই?

অধিনায়ক হিসেবে আজহার বা মহেন্দ্র সিং ধোনির যেটা সর্বক্ষণের সাথী ছিল, সৌরভের আংশিক সময়ের সাথী সেই ‘ভাগ্য’ বা ‘ক্যাপ্টেনস লাক’ একদমই ছিল না শচিনের। প্রথমত ’৯৬ বিশ্বকাপের ধাক্কা সামলে দলটা একটা ট্রানজিশন পিরিয়ডের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সৌরভ দ্রাবিড় লক্ষণ প্রসাদ জোশির মতো তরুণরা দলে জায়গা পাকা করার চেষ্টা করছেন আবার অন্যদিকে সেরা স্ট্রাইক বোলার কুম্বলের অফ ফর্ম আর শ্রীনাথের চোট।

ads

একসঙ্গে সামলাতে হয়েছিল শচীনকে। তার সঙ্গে তাঁর অধিনায়ক হওয়ার প্রথম বর্ষপূর্তির আগেই এমন ভাঙাচোরা দল নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দুটো কঠিন সফর। আর আবে কুরুভিল্লা যদি কোন দলের প্রধান স্ট্রাইক বোলার হন তো সে দলের টেস্ট জেতারও কথা নয়।

তবে শুধু ভাগ্য অবশ্যই নয়। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে পরপর দুটো টেস্ট বড় ব্যবধানে হারার পরে জোহানেসবার্গ টেস্টে কিন্তু শেষদিনে সাড়ে তিনশ তাড়া করতে নামা প্রোটিয়া বাহিনীকে ৯৫/৭ করে দিয়েছিল দিনের মধ্যভাগের মধ্যেই। তারপরে কালিনান আর ক্লুসনার দাঁড়িয়ে গেলেন এবং শেষের ঘন্টা দেড়েক দৃষ্টিকটুভাবে বিভিন্ন আছিলায় সময় নষ্ট করে টেস্টটা ড্র করে দিলেন।

যেটা নিয়ে কমেন্ট্রি বক্সে সুনীল গাভাস্কার পর্যন্ত সোচ্চার হলেও মাঠে নিপাট ভাল মানুষ অধিনায়ক কখনোই কোনো বাড়তি প্রচেষ্টা বা প্রতিবাদ করেননি। ’৯৭ এর বার্বাডোজের বিকেলটাতেও মাত্র ১২০ তাড়া করা যায়নি ভঙ্গুর ব্যাটিং এবং ততধিক খারাপ পিচের দাক্ষিণ্যে। অথচ এই দুটো টেস্টের ফলাফল একটু এদিক ওদিক হলেই অধিনায়ক শচীনের বায়োডাটা অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে যেত।

আজকের যুগে যেটা নেপটিসম সেটাই তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেটে ‘আমচি মুম্বাই’। স্বয়ং স্যার ডন ব্র্যাডম্যান যাঁর ব্যাটিং দেখে বলেছিলেন যে ছেলেটা অনেকটা আমার মতো ব্যাটিং করে, তিনিও এই অসুখের বাইরে বেরোতে পারেননি। দিনের পর দিন অযোগ্য কুরুভিল্লাকে খেলিয়ে গেছেন কিন্তু হাতে ভাল স্যুইং থাকা সত্ত্বেও দেবাশীষ মোহান্তিকে তাঁর, টেস্ট ম্যাচের আসরে কখনো মনে পড়েনি।

অথচ, এই মোহান্তিই তাঁর ’৯৭-এ টরন্টোতে করা অপারেশন পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, সাইদ আনোয়ারকে দিয়ে রোজ প্রাতরাশ সারতেন। পরিসংখ্যান বলছে দুই পর্ব জুড়ে শচীন যতগুলো ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছেন তার এক তৃতীয়াংশ ম্যাচে আবে কুরুভিল্লা খেলেছেন এবং ওটাই তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের মোট পরিসর।

সৌরভ ইস্যুতে বাঙালিরা চিরকাল আজহারউদ্দীনকে দায়ী করে কিন্তু ’৯৬ এর লর্ডসের পরে আজহার একটা দিনের জন্যও সৌরভকে প্রথম এগারোর বাইরে রাখেননি (চোট ব্যতীত) বরং টেস্ট এবং সীমিত ওভার দুই জায়গাতেই শচীন তাঁকে বাইরে বসিয়েছেন। সাত নম্বরে নেমে বিপর্যয় বাঁচিয়ে জীবনের প্ৰথম অর্ধশতরানের পুরস্কার হিসেবে অধিনায়ক পরের ম্যাচে তাঁকে আট নম্বরে পাঠিয়েছেন এবং তার পরের ম্যাচে বাদও দিয়েছেন। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতাতেই অফ ফর্মে বাল্য বন্ধু কাম্বলির জায়গা হয়েছে টপ অর্ডারে। বার্বাডোজ টেস্ট ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা আর অযোগ্য পিচের জন্য ম্যাচ হারার পরের টেস্টে বাড়তি বোলার নিয়ে মাঠে নামার অজুহাতে বাদ দিলেন সৌরভকে।

অথচ এই সৌরভকেই টরন্টোতে বাদ দেওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যে টাইটান কাপে ওপেন করতে পাঠিয়ে দিলেন। আর এখান থেকেই যে প্রশ্নটা অবধারিত উঠে আসে সেটা হলো মাঝে মধ্যে নেওয়া এই সব হঠকারী সিদ্ধান্তগুলো একান্তই কি তাঁর সিদ্ধান্ত নাকি তাঁর ভাল মানুষির সুযোগ নিয়ে পর্দার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন তৎকালীন কোচ বা অন্য কেউ। আর চিরকাল বিতর্কের শত মাইল দূরে থাকা মানুষটি কোনদিন এই বিষয় জল ঘোলা পর্যন্ত করেননি।

২০০০-এর শুরুতে সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে তিনি ফোন করে পরিবর্ত উইকেটরক্ষক হিসেবে চাইলেন সামির দিঘেকে আর মিস্টার লেলের ফোন পেয়ে অস্ট্রেলিয়াগামী বিমানে চড়ে বসলেন নয়ন মোঙ্গিয়া। এমন সব বিষাক্ত ডেলিভারিও অধিনায়ক শচীন সামলেছেন।

আশ্চর্যজনক ভাবে শচীন অধিনায়ক থাকাকালীন রাহুল দ্রাবিড় এবং লক্ষণ দুজনেরই পারফরম্যান্স ভীষন ভীষণ ভাবে খারাপ। দ্রাবিড় এই সময় সাকুল্যে একটা টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন। আর লক্ষণের গড় তো ইডেন টেস্টের আগে পর্যন্ত ২৫ এর আশেপাশে ছিল। আর অধিনায়ক স্বয়ং ১৯৯৮-এ যে ফর্মে ছিলেন তাঁর আগের বছর বা পরের বছর তাঁর পঞ্চাশ শতাংশ খেলতে পারলেও অনেক ম্যাচ বেরিয়ে যেত।

তবে টেস্ট এবং ওয়ান ডে, দুই জায়গাতেই যতই তিনি নূন্যতম একবার করে বাদ দিন না কেন, তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সৈনিক ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী, দুনিয়ার যে কোন প্রান্তে। ব্যাটসম্যান সৌরভ গাঙ্গুলী ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা কাটিয়েছেন আজহার আর শচীনের সময়কালেই। টাইটান কাপ বাদে অধিনায়ক শচীন যতটুকু সাফল্য পেয়েছেন তার পেছনে এই বাঙালির অবদান অনস্বীকার্য।

আর একটা বিষয় কাজ করত তাঁর সময়ে ম্যাচে জয় পরাজয়ের ব্যাপারে; সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মিডল অর্ডারের ইচ্ছাকৃত এবং অনিচ্ছাকৃত ব্যর্থতা। ম্যাচ ফিক্সিং সংক্রান্ত বিতর্কে না ঢুকে এটুকু বলাই যায় যে ভারতের যে অধিনায়ক ম্যাচ ফিক্সিং কাণ্ডের জেরে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত নির্দ্বিধায় তাঁর নাম শচীন টেন্ডুলকর। কিছু কিছু খেলোয়াড়ের অসহযোগিতা এই সময় চরম পর্যায়ে পৌঁছয়।

হ্যাঁ, এটা ঠিক যে সহ খেলোয়াড়দের থেকে সেরা পারফরমেন্স বের করে আনার ব্যাপারে তাঁর অক্ষমতা ছিল, সবার কাছ থেকে ‘শচীন’ সুলভ পারফরম্যান্স আশা করতেন, কিন্তু শুধুমাত্র এইসব কারনে স্কোর কার্ড দেখে অধিনায়ক শচীনকে বিচার করাটা খুব কঠিন কাজ। কারন অধিনায়ক শচীনের সাফল্য এবং ব্যর্থতার মধ্যে যে দেওয়ালটা আছে তাতে শচীনের নিজের এবং ভারতীয় ক্রিকেটের অনেক অব্যক্ত কাহিনী রয়ে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link