More

Social Media

Light
Dark

কান্না হওয়া কৌতুক!

ড্রেসিং রুম – ক্রিকেট দলের অমোঘ সত্যের এক ঘর। ম্যাচের পরিকল্পনা, জয়ের আনন্দ, পরাজয়ের বিষাদ – সবকিছুকেই ঘিরে থাকে এই ঘরটা। এখানেই তৈরি হয় নতুন অভিষিক্তের সাথে পোড় খাওয়া ক্রিকেটারের বন্ধুত্ব, এখানেই তৈরি হয় মনে রাখার মত সব গল্প, এখানটা ঘিরেই একজন ক্রিকেটার লিখে ফেলতে পারেন আস্ত একটা বইও।

ঠিক এরকমই একটা গল্প যুবরাজ সিং বলেছিলেন অনেক আগে, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) চলাকালে। গল্পটা ভারতের ড্রেসিং রুমের, গল্পটা সৌরভ গাঙ্গুলির, গল্পটা হাল আমলের পরিচিত শব্দ ‘প্র্যাঙ্ক’-এর!

  • ইতিহাস

আইসিসি নকআউট টুর্নামেন্ট, ২০০০!

ads

কেনিয়ার বিপক্ষের ভারতের ম্যাচের ঠিক আগের দিন রাত। যুবরাজ সিংয়ের তখনও অভিষেক হয়নি। কিন্তু জোর সম্ভাবনা (কিংবা বলা যেতে পারে নিশ্চয়তা) ছিল যে কেনিয়ার বিপক্ষেই যুবরাজের ওয়ানডে অভিষেকটা হয়ে যাবে। ঠিক সে রাতেই, সৌরভ গাঙ্গুলি এলেন যুবরাজ সিংয়ের কাছে!

দলের নবাগত যুবরাজকে সৌরভ প্রস্তাব দিয়ে বসলেন, ‘ওপেন কারেগা না?’ (ওপেন করবে তো?)

যুবরাজ সিং এমনিতেই চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসতেন, নতুন কোন পরিস্থিতিই তাকে কখনও ঘাবড়াতে পারত না। এবারও দলে অভিষিক্ত না হওয়া যুবরাজ ঘাবড়ালেন না। সৌরভ গাঙ্গুলিকে তিনি ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেন। সৌরভ এবার ফিরে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন একরাশ উত্তেজনা।

সে রাতে যুবরাজের আর ঘুম এল না। কিন্তু ম্যাচের আগে তো ঘুমও জরুরী । তিনি এপাশ ওপাশ করতে লাগলেন, উত্তেজনায় ছটফট করতে লাগলেন, অবস্থা এমন হল যে সে রাতে তাকে স্লিপিং পিল অবধি নিতে হয়েছিল!

ম্যাচের দিন সকাল। ব্রেকফাস্ট করতে করতে সৌরভ যুবরাজকে আবার ডাকলেন। এবার ডেকে কি বললেন? – ‘কাল রাতের ওটা একটা জোক ছিল!’

সৌরভ গাঙ্গুলির জন্য ব্যাপারটা এখানেই থেমে গেল। দলে আসা নতুন খেলোয়াড়কে নিয়ে করা মশকরা তিনি ভুলে গেলেন। কিন্তু যুবরাজ? তিনি কিন্তু ভুললেন না!

  • প্রতিশোধ

কোচি, ২০০৫!

পরদিন ছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সাথে ম্যাচ। ম্যাচের আগের দিন সৌরভ তাঁর চিরাচরিত দম্ভ নিয়ে যাচ্ছিল টিম মিটিংয়ে। টিম মিটিং যেখানে হওয়ার কথা ছিল, তিনি সে ঘরে ঢুকে দেখলেন সেখানে ইতোমধ্যে সবাই উপস্থিত হয়ে আছে। সৌরভ গাঙ্গুলিকে সেখানে দেখামাত্র সবাই একেবারে পিনপতন নীরব হয়ে যায়। সৌরভও ভাবতে থাকেন, যাক! এবার টিম মিটিং টা সেরে ফেলে দরকার!

কিন্তু তিনি তো জানতেন না একটু পর কি হতে যাচ্ছে!

সৌরভ গাঙ্গুলি টিম মিটিংয়ে বসলেন, স্ট্রাটেজি আর ট্যাক্টিকস নিয়ে আলাপ করা শুরু করলেন আর কিছু সময় পরেই খেয়াল করলেন টিম মিটিংয়ের কেউই তাঁর কথা শুনছে না। তিনি একে একে সবার দিকে তাকালেন, সৌরভের চোখের জিজ্ঞাসার উত্তরে তখন খেলোয়াড়েরা তাঁকে সেদিনের দৈনিক পত্রিকাটা বাড়িয়ে দিল!

সেই পত্রিকাতে কী ছিল?

সেই পত্রিকাতে ছিল সৌরভ গাঙ্গুলির সাক্ষাৎকার। আর সেই সাক্ষাৎকারে দেখা যাচ্ছিল তিনি তাঁর খেলোয়াড়দের খুবই কুৎসিতভাবে সমালোচনা করেছেন।

সৌরভের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এ কাণ্ড তিনি কখন করেছেন? কখন সাক্ষাৎকার দিয়েছেন? আর কেনই বা যুবরাজ, হরভজন আর শেবাগের মত ক্রিকেটারদের নিয়ে তিনি এমন সমালোচনা করবেন? তাও আবার মিডিয়াতে! সৌরভ মনে করতে পারলেন না। তিনি একে একে যুবরাজ, হরভজন আর শেবাগের দিকে তাকালেন। টিম ম্যানেজার উইং কমান্ডার এম বলদিত্যের দিকে তাকালেন, তাঁকেও পত্রিকার একটা কপি দেওয়া হয়েছে।

সৌরভ হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি উঠে গিয়ে একে একে সব ক্রিকেটারের কাছে যেতে লাগলেন, বোঝাতে লাগলেন এমন কোন কাজ তিনি করেননি। কিন্তু পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে গেল যখন টিম ম্যানেজারকে দেওয়া পত্রিকার সাক্ষাৎকার জোরে জোরে পুরো দলের সামনে পড়া হতে লাগল?

একজন অধিনায়ক হয়ে দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে মিডিয়াতে এমন বাজে মন্তব্য কেউ করে?

পরিস্থিতি এমনিতেই বাজে ছিল, সেটা একেবারে নোংরা হয়ে গেল এরপর। দলের এক খেলোয়াড় উঠে দাঁড়িয়ে একেবারে সোজাসুজি সৌরভের অধিনায়কত্বের সমালোচনা করতে লাগল। সৌরভ সেই মুহুর্ত স্মরণ করে পরে বলেছেন, ‘আমি প্রায় কেঁদেই ফেলছিলাম।’

সৌরভ আশেপাশে তাকালেন, যদি কেউ অন্তত তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসে। কিন্তু না, কেউ এল না। পুরো একটা দল সে ঘরে একদিকে, আর সৌরভ গাঙ্গুলি আরেকদিকে।

হরভজন সিং আর আশীষ নেহরা ঘরের মধ্যেই হঠাৎ ঝড় তুলে ফেললেন। সৌরভের দিকে একের পর এক তীক্ষ্ণ কথার বাণ ছুঁটে আসতে লাগল। সৌরভ আর সেসব নিতে পারলেন না। তিনি তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, দলের সবাইকে বললেন তিনি অধিনায়কত্ব থেকে পদত্যাগ করছেন আর প্রমিজ করছেন এমন স্টেটমেন্ট আর বাইরে কোনদিন দেবেন না!

কিন্তু, সৌরভ গাঙ্গুলি তখনও মনে করতে পারেননি – এমন স্টেটমেন্ট তিনি কবে দিয়েছেন?

সৌরভ গাঙ্গুলি একেবারে ভেঙে পড়লেন। বিমর্ষ সৌরভকে আর নিপাট ভদ্রলোক রাহুল দ্রাবিড় দেখতে পারলেন না। তিনি উঠে গিয়ে সৌরভের কাছে গেলেন আর সত্যিটা বলে দিলেন, ‘এটা একটা এপ্রিল ফুল প্র্যাঙ্ক ছিল!

সৌরভ গাঙ্গুলির তখন কেমন লাগছিল? পরে দাদা বলেছেন, তাঁর বিব্রত হওয়ার বদলে অনেকটা হাফ ছাড়ার মত লেগেছিল। কিন্তু সেই ধাক্কা তখনও তিনি কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না। আর ঠিক সেই সময়েই তাঁকে আরেকটা কাগজ বাড়িয়ে দেওয়া হয়!

এটাতে আবার কি?

সৌরভ আরেকবার ভয় পেয়ে গেলেন। অপ্রস্তুতের মত কাগজটা খুললেন। আর এবার যেটা দেখলেন তাতে তাঁর হৃদয় ছুঁয়ে গেল। কাগজটাতে দলের সবার স্বাক্ষর ছিল আর সেখানে লেখা ছিল,‘দাদা, আমরা সবাই তোমাকে ভালোবাসি!’

সৌরভ সাথে সাথে উঠে গিয়ে সবাইকে একে একে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি বুঝতে পারলেন দলের সবাই তাকে কত ভালোবাসে। কিন্তু সাথে এটাও সাবধান করে দিলেন, এমন যেন কখনও না হয়!

  • পাদটীকা

আসল ঘটনাটা ছিল, যুবরাজ ঠিক পাঁচ বছর আগের প্রাংকের একটা প্রতিশোধ নিয়েছিল । সে একটা নিউজপেপার নিজ দায়িত্বে প্রিন্ট করিয়ে সেখানে সৌরভের একটা কাল্পনিক ইন্টারভিউ দিয়েছিল আর দলের সবাইকে নিয়ে এমন একটা কৌতুকের আয়োজন করেছিল।

যুবরাজকে আলিঙ্গনের সময় সৌরভ কি পাঁচ বছর আগের সকালে ফিরে গেছিলেন?

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link