More

Social Media

Light
Dark

দ্য লিজেন্ড অব টাইগার-শর্মিলা পার্টনারশিপ

বলিউড এবং ক্রিকেট – দুটিই ভারতের গ্ল্যামারস জগত। ভারতের প্রায় সব ছেলে মেয়েরই স্বপ্ন থাকে গ্ল্যামারস এই জগত নিয়ে। দর্শক মহলে তাঁদের নিয়ে আগ্রহও প্রচুর। এই দুই জগতের দুর্দান্ত প্রেমের গল্প সৃষ্টি হয়েছে বেশ কয়েকবারই। হালের বিরাট কোহলি ও আনুশকা শর্মাকে নিয়ে যেমন আগ্রহ তেমনি একটা সময় আগ্রহ ছিল ছিল টাইগার পতৌদি ও শর্মিলা ঠাকুরকে নিয়ে। তবে, পতৌদি-টাইগারের গল্পটা ছিল একদমই আলাদা।

সিনেমার সাথে ক্রিকেটের মেলবন্ধন তখনও আজকের মত রূপ নেয়নি। তাই এই দু’জনের এক হওয়াটা ছিল বিশেষ একটা ব্যাপার। দেরি না করে শুরু করা যাক।

মনসুর আলী খান পতৌদি বেশি পরিচিত ছিলেন টাইগার পতৌদি নামে। তিনি ছিলেন ভারতের সবচেয়ে কম বয়সী অধিনায়ক। বাবা স্বয়ং ইফতেখার আলী খান পতৌদি, যিনি ভারত ও ইংল্যান্ড – দু’টো দলের হয়ে টেস্ট খেলেছেন, অ্যাশেজের ময়দানে করেছেন সেঞ্চুরি। আর শর্মিলা ঠাকুর ছিলেন তখকার সময়ের বলিউডের হার্ট থ্রুব। তাঁর স্টাইলিশ ব্যাটিং, কথা বলার ধরণ, অধিনায়কত্ব, কিংবা সানগ্লাস পরে হাঁটার ভঙ্গি – সবই ছিল অনন্য।

ads

সময়টা ১৯৬৫, দিল্লীতে খেলা দেখতে এসেছিলেন বলিউডের গ্ল্যামার গার্ল শর্মিলা ঠাকুর। আর সেখানেই ম্যাচ শেষে এক অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় টাইগার পতৌদি এবং শর্মিলা ঠাকুরের।

তাঁরা দুই জনই বিভিন্ন সময় দেয়া সাক্ষাৎকারে জানান, টাইগার পতৌদি শর্মিলা ঠাকুরের ছবি খুব বেশি দেখেননি। আর শর্মিলা ঠাকুর ক্রিকেট সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তারপরও তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক হয়েছিলো এবং তাঁদের সম্পর্ক খবরের শিরোনাম হয়েছিলো।

টাইগার পতৌদি ছিলেন একজন নবাব পরিবারের সদস্য। সাথে বেশ সুদর্শন পুরুষ। আর শর্মিলা ঠাকুর ছিলেন বলিউডের কাছে বাংলার সেরা উপহার। আর সেই সময়ের হার্ট থ্রুব নায়িকা, কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের মেয়ে।

তাঁরা দুইজনই ছিলেন বেশ সফল এবং ভিন্ন পথের পথ প্রদর্শক।

খ্যাতনামা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট মনসুর আলি খান পতৌদি ছিলেন সময়ের অন্য ছেলেদের থেকে একটু ভিন্ন ধরনের। ছিলেন যথেষ্ট পরিমান পশ্চিমা ঘরানার চাল চলনের এক ব্যক্তি। ক্রিকেটে এসে সাফল্য পেতে খুব বেশি সময় লাগেনি তার। ছিলেন ভারতের সবচেয়ে দূরদর্শী অধিনায়ক। কিন্তু এক দুর্ঘটনার কারণে হারিয়ে ফেলেন তার ডান চোখ।

মাত্র ১৩ বছর বয়সেই অভিনয় জগতে পা রাখেন শর্মিলা ঠাকুর। সত্যজিত রায়ের পরিচালনায় চলচিত্রে অভিষেক ঘটে তার। বলিউডে সাফল্য পেতে খুব বেশি সময় নেননি তিনি। অতি দ্রুতই সাফল্য পান শর্মিলা ঠাকুর। বলিউডে যেসব অভিনেত্রীকে পোস্টার গার্ল হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিলো তখন,তার মধ্যে শর্মিলা ঠাকুর বেশ দ্রুতই বিভিন্ন ব্লক বাস্টার সিনেমা করে ফেলেন।

সাফল্যের দিক থেকে তাঁদের মধ্যে বেশ মিল থাকলেও তাঁদের মধ্যে অমিলের পরিমানও কিন্তু কম নয়।

পতৌদি ছিলেন নবাব পরিবারের সন্তান। তাঁদের পরিবারের কেউ অভিনয় জগতে থাকবে সেটা ভাবাই অকল্পনীয়। আর শর্মিলা ঠাকুর ছিলেন কলকাতার ঠাকুর পরিবারের একজন সদস্য। সেখানে টাইগার পতৌদির মত পশ্চিমা সংস্কৃতির কেউ আসবে সেটা মেনে নেয়া টা ছিলো ঠাকুর পরিবারের জন্য বেশ কষ্টকর।

কিন্তু তাঁদের ভালোবাসায় ছেদ ঘটাতে পারেনি পরিবারিক এই অমিল।

বেশ কয়েক বছর প্রণয় চলে। পরে প্রণয় থেকে পরিণয় হয় ১৯৬৯ সালে। আর্কষণীয় বিষয় ছিল প্যারিসে পতৌদির প্রপোজ করার ঘটনা।। দুই জনই প্রস্তাবের আগে পরিবারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে পরস্পরকে জানিয়েছিলেন। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এই সম্পর্ককে নিয়তি হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছিলো। বলেছিল – টিকবে না এই বিয়ে। তাঁদের আশেপাশের লোকজন সবাই অবাক হয়েছিলো এই সম্পর্কের বিষয়ে।

১৯৬০ এর দশকে ভারত খুব বেশি প্রগতিশীল কোনো দেশ ছিলো না। কিন্তু তখনই প্রগতিশীল সমাজের পরিচয় দিয়েছিলেন তাঁরা। তখনকার সমাজের তরুণ-তরুণীরা টাইগার পতৌদি এবং শর্মিলা ঠাকুরের সম্পর্ককে কল্পিত সম্পর্ক হিসেবে বিবেচনা করেছিলো।

এই বিয়েটি ছিলো প্রধানত আন্ত:বিশ্বাসের একটি বিয়ে। ধর্মীয় দিক থেকে এই বিয়ের ছিলো না কোনো স্বীকৃতি। তাঁদের বিয়ের মূল ভরসার জায়গাটাই ছিলো ভালোবাসা। শর্মিলা ঠাকুর এমন ভাবে বলেছিলেন যে তাঁদের সম্পর্কে ধর্ম কখনোই বড় কোনো বিষয় ছিল না।

আমরা যখন বিয়ে করেছিলাম আমরা তখন ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং সাম্প্রদায়িকতা এই শব্দ দুইটি সম্পর্কে জানতাম না। আমরা তরুণ বয়সে প্রেমে পড়েছিলাম, আমরা জানতাম না আমাদের চারপাশে কি ঘটছিলো। আমাদের বিয়ে সাধারণ ভাবে এক সাথে থাকার ভাবনা থেকে হয়নি, এক সাথে থাকার তীব্র আকাঙ্খা থেকেই এই বিয়েটা হয়েছিলো।

ভারতীয়দের ইতিহাসের প্রথম দিককার আধুনিক দম্পতির মধ্যে একটি হলো টাইগার পতৌদি এবং শর্মিলা ঠাকুর জুটি। ১৯৬৭ সালে প্রথম বলিউড অভিনেত্রী হিসেবে বিকিনি পরে ফটোশুট করেন শর্মিলা ঠাকুর। একই সময় তিনি টাইগার পতৌদির সাথে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু বিকিনি পড়ে এই ফটোশুট তাঁদের সম্পর্কে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেনি। শর্মিলা ঠাকুর তার নিজের মত করেই কাজ করতে পেরেছেন এবং এতে সব সময় সমর্থন দিয়ে গিয়েছেন টাইগার পতৌদি।

বিয়ের পর তাঁরা বাঁধাধরা নিয়মকে ভেঙেছিলেন। যেখানে অভিনেত্রীরা বিয়ের পর গ্ল্যামারাস জগত ছেড়ে দিচ্ছিলেন সেখানে ব্যতিক্রম ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। এমনকি তাঁদের প্রথম সন্তান সাইফ আলী খানের জন্মের পরও অভিনয় চালিয়ে গিয়েছিলেন শর্মিলা ঠাকুর।

 

টাইগার পতৌদি এবং শর্মিলা ঠাকুরের বিয়ের পর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম বলেছিলো এই বিয়ে স্থায়ী হবে না। তাঁরা এর কারণ হিসেবে তাঁদের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে সামনে নিয়ে এসেছিল। এছাড়াও তাঁরা দুইজনই ছিলেন দুই জগতের তারকা। তাই সংবাদমধ্যম বলেছিলো কিছু দিন পরেই ভেঙে যাবে তাঁদের এই সংসার। কিন্তু তাঁরা তাদের ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিচয় দিয়ে ৪২ বছর আগলে রেখেছিলেন তাঁদের সংসারকে।

বিয়ের পর ধর্ম ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য কোনো সমস্যার সৃষ্টি তো করেইনি, বরং দু’জনের মধ্যেই তাতে এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। শর্মিলা বলেন, ‘টাইগার পতৌদিকে বিয়ে করার পর আমি কিছু ছাড়িনি। তার মতামত ছিলো খুবই উদার। আমি প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। সাথে অন্যদের সংস্কৃতি, খাদ্য এবং পোশাক সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। আমি প্রচুর উপকৃত হয়েছি।’

একে অপরের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সন্মানের প্রতি লক্ষ্য রেখেই এই বিয়ে হয়েছিলো। তাঁরা তাঁদের সামাজিক রীতিনীতি ভেঙেছিলেন। তাঁরা নিজস্ব নিয়মে একসাথে বসবাস করেছিলেন। ভক্তদের দিয়ে গিয়েছেন সারাজীবন মনে রাখার মত একটি ভালোবাসার গল্প। সেই স্মৃতি আজো অমলিন।

বিয়ে তাঁদের ক্যারিয়ারের পথেও কখনো বাঁধা হয়নি। শর্মিলা দিব্যি পুরোটা জীবন অভিনয় চালিয়ে গেছেন। শেষ দিকে বলিউডের সেন্সর বোর্ডের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। ছেলে-মেয়েরা মায়ের হাত ধরে এসেছেন অভিনয়ে। পতৌদি মাঠের জীবন শেষ করেও ছিলেন বোর্ডের সাথে। বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) প্রধান নির্বাচক ছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে, দু’জনই জীবনের যেকোনো পর্যায়ে ছিলেন বেশ সফল।

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link