More

Social Media

Light
Dark

ম্যাঁয় সৌরভ গাঙ্গুলি হুঁ! ভুলে তো নেহি?

চ্যাপেল এর সাথে দ্বৈরথ হচ্ছে আমার ক্রিকেট জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়। ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলের কোচ, দলে সৌরভ গাঙ্গুলী কে ফিরতে দিচ্ছেনা, এই তথ্যটা সম্ভবত ভারতেই সবচেয়ে গোপনে সামলে রাখা কিন্তু কুৎসিত সত্য কথা। মিডিয়ার মাধ্যমে ভদ্রলোক আমাকে বিদায়ী ম্যাচ খেলার অফার পর্যন্ত করেছিলেন। তখন আমার একমাত্র আশা ছিলো দলের অধিনায়ক, আমি অধিনায়ক থাকাকালীন সময়ে টানা পাঁচবছর দলের সহ-অধিনায়ক এবং ঘনিষ্ট বন্ধু।

রাহুল দ্রাবিড়।

দ্রাবিড়কে দুবার ফোন করেছিলাম, মনে আছে আমার। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমার সামনে করনীয় কী? রাস্তা কি খোলা আছে? যদি স্মৃতি বিট্রে না করে থাকে, আমি ওকে প্রথম ফোন করেছিলাম ২০০৬ এর এপ্রিলে। এরপরের কল ছিলো সেই বছরেরই জুন মাসে। অধিনায়ক আমাকে আস্বস্ত করলেন, এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি, আমারও সময় আসবে। কিন্তু বদলালো না কিছুই। সিলেকশন বোর্ডের মিটিং হচ্ছে। দলে নতুন মুখ আসছে। প্রতিবারই আমার বদলে অন্য কাউকে দলে নেয়া হচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম না যে আসলে সমস্যাটা কোথায়। আমার খেলার সামর্থ্যে সমস্যা না অন্যকিছু?

ads

সমস্যা যাই থাকুক, আমার জন্যে মেসেজ কিন্তু একদম পরিষ্কার। দলে যতোদিন চ্যাপেল আছে ততোদিন আমার কোন সুযোগ নেই। পাঁচজন নির্বাচক দল নির্বাচন করেন সত্যি, কিন্তু সবাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কোচ দিয়ে প্রভাবিত। গোটা ভারত যাই ভাবুক, আমি তাঁদের কাছে অবাঞ্ছিত একজন।

বোর্ডের প্রধান শরদ পাওয়ার এর সাথে আমি একাও কথা বলেছি। ভদ্রলোক আমার সাথে খুবই চমৎকার ব্যবহার করেছিলেন, তাঁর কথাগুলো আমার এখনো মনে আছে। সমস্যা হচ্ছে ভদ্রলোক যা বলেছিলেন, তা আমার হজম করতে খুবই কষ্ট হয়েছে। বলেছিলেন, ‘ব্যক্তিগত ভাবে তোমার সম্পর্কে আমার ধারণা খুবই ভালো। কিন্তু কোচের ভাবনা একেবারেই আমার ভাবনার উলটো। তার কথা হচ্ছে তোমার উপস্থিতি দলে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।’

এই অভিযোগ, এই কথাটা আমার জন্যে মেনে নেয়া খুবই কঠিন, কিছুটা আবেগও জাপটে ধরেছিলো। বললাম, ‘স্যার, আপনি দলের অন্য খেলোয়াড়দের সাথে কথা বলে কেন জেনে নিচ্ছেন না যে আমার উপস্থিতি দলের জন্যে আসলে কতোটা ক্ষতির কারণ হবে? এই দলটায় আমি অধিনায়ক ছিলাম পাঁচ বছর ধরে, এখন হঠাত করেই এই দলের জন্যে হয়ে গেলাম ক্ষতিকর মানুষ? আমি নিজে হাতে ধরে ধরে এই দল তৈরী করেছি। নিজের ব্যাটিং স্লট ছেড়ে দিয়েছি। বিপক্ষ দলের অধিনায়কদের সাথে লড়েছি যেন ওরা ভারতীয় দলটাকে সিরিয়াসলি নেয়। ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছি প্রায় দুইশো ম্যাচ। আর এখন হঠাত করেই আমি হয়ে গেলাম দলের জন্যে ক্ষতিকর একজন?’

পাওয়ার বললেন, ‘তোমাকে আমি বিশ্বাস করি সৌরভ। কিন্তু নিশ্চিত হবার জন্যে আমাকে দলের বাকী সদস্যদের সাথে কথা বলতে হবে।’ পরে আমার মনে হয়েছে পাকিস্তান ট্যুরে আমাকে দলে নেয়ার পেছনে কি শচীন এর সাথে শরদ পাওয়ারের কথাবার্তার কোন ভূমিকা ছিলো? কখনো জানতে পারিনি বিষয়টা। শরদ পাওয়ার আমার জন্যে ছিলেন একবার ব্যবহার করা যায় এমন একজন লাইফ লাইন। সেটাও ব্যবহার করে ফেলেছি। বারবার তো তাঁকে বিরক্ত করা যায়না। করা উচিৎ ও না। কিন্তু ভদ্রলোক ও সময়ে যেভাবে পরিস্থিতি সামলেছিলেন, যে সততার সাথে সব করেছিলেন, তা আমি আজীবন বুকের ভেতর পুষে রাখবো।

সমস্ত চেষ্টা করে যখন চুপচাপ বসে আছি, মনে হলো আসলেই কি এই কালো দিনের শেষে আলো আসার কোন সম্ভাবনা আছে? বাড়ীতে পরিস্থিতি তো আরো কঠিন, কেমন একটা শীতল কিন্তু টের পাওয়া যায় এমন টেনশন। আমার স্ত্রীও চুপচাপ কিন্তু আচরণে বিষন্নতা টা টের পাওয়া যাচ্ছিলো। বাড়িতে নানান সময় মায়ের কাছে জ্যোতিষীরা আসা-যাওয়া করছেন, দেখতে পাচ্ছি। আমার মা তখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, শুধুমাত্র একটা বিশেষ পাথর বা তাগা শরীরে ধারণ করলেই আমার দুঃসময় কেটে যাবে। আমার অবশ্য সেরকম বিশ্বাস ছিলনা।

আমার বাবা আমার সাথে পেশাগত ব্যাপার স্যাপার নিয়ে খুবই কম আলোচনা করতেন। কিন্তু এক বিকেলে বাবা হাতে করে নিয়ে এলেন একটা খবরের কাগজ। তাতে একটা রিপোর্ট, রিপোর্টে বলা হচ্ছে ওয়েষ্ট ইন্ডিজে ওয়ান-ডে ক্রিকেটে ভারতের সিরিজ বিজয় সৌরভের জন্যে দলে ঢোকার দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিলো। ক্রিকেটের ব্যাপার স্যাপার নিয়ে বাপির সাথে অনেকদিন পরে সেদিন কথা হলো। মনে হচ্ছিলো সেই আগেকার দিনে ফিরে গেছি, আমি তখন চৌদ্দ বছরের এক অনিশ্চিত এবং কৌতুহলী কিশোর আর সামনে আমার বাবা, আমার মেন্টর।

বাবার মনে হচ্ছিলো, ভারতীয় দল যতো ম্যাচ জিতে চলেছে, আমার আবার দলে ঢোকার সম্ভাবনা ততো কমে যাচ্ছে। বাবা বললেন। “মহারাজ, অনেক কিছু তো পেয়েছো। এখন সন্মানের সাথে বিদায় নিয়ে নিলে হয় না?” বাবার গলায় আমার জন্যে উদ্বেগ এবং একরাশ বিষন্নতা। বাবার গলায় আমার নিজেকেও কেমন অসহায় মনে হচ্ছিলো। শেষমেশ বাবা খুব কঠিন কথাটা অনেক কষ্টে বলেই ফেললেন, ‘মহারাজ, বিশ্বাস করো, আমি তোমার আর কোন সুযোগ দেখতে পাচ্ছিনা। বেদনার বিষয় হচ্ছে আর কোন আশা নেই।’

বাবা আর ছেলের মাঝে খুব আবেগ নিয়ে কথাবার্তা চলছে। আমার বাবা এখন নেই, আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু তাঁকে কী বলেছিলাম তা আমার পরিষ্কার মনে আছে। বলেছিলাম, ‘কেউই তো সারাজীবন খেলতে পারেনা। সর্বকালের সেরারাও তো একসময় নিজের খেলা ছেড়েছেন, তা ম্যারাডোনা হোক, পিট সাম্প্রাস হোক কিংবা গাভাস্কার। সবাইকেই একটা সময় থামতে হয়েছে। আমিও জানি আজ হোক বা কাল আমাকেও থামতে হবে। কিন্তু পরিস্থিতি যখন পুরোটাই প্রতিকূলে তখন আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করিনি, এই ভাবনা নিয়ে আমি বাঁচতে চাইনা। যতোক্ষন পর্যন্ত না দেখবো একেবারেই অসম্ভব ততোক্ষন পর্যন্ত আমি আমার লড়াই চালিয়ে যাবো। হ্যাঁ, অবসর নিয়ে নেয়ার সহজ রাস্তা আমার জন্যে আছে। ক্রিকেট থেকে আমি যা পেয়েছি, অর্জন করেছি তা দিয়ে নিশ্চিন্তে বাকী জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো। কিন্তু বাকীটা জীবন আমি সোফায় আরামে বসে বসে এই ভাবনা নিয়ে বাঁচতে চাইনা যে আমি আমার সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করিনি। আমার নিজের কাছেই নিজে তখন ছোট হয়ে যাবো।’

সারাজীবন আমি যাই করেছি, বাবার তাতে সমর্থন ছিলো, এবারেও বাবা শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে সন্মতি দিলেন, কিছুই বলেননি। সন্মতি দিলেও আমি জানি বাবা আমার কথায় খুব একটা বিশ্বাস রাখতে পারছেন না। কথাবার্তা শেষ। আমি আমার রুমে ফেরত গেলাম। রাতে নিজেই নিজেকে বললাম, ‘সৌরভ, নিজেকে আরেকটা বছর সময় দাও, দেখো কী হয়’। ঐ রাতেই তিনটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

আমি কঠিন ট্রেইনিং চালিয়ে যাবো।

এই মৌসুমে রঞ্জির সমস্ত ম্যাচ খেলবো।

কোনভাবেই আশা ছাড়া যাবেনা।

এরপরেই একজন ব্যক্তিগত ট্রেইনার ভাড়া করে ফেললাম। ট্রেইনারের সাথে সপ্তাহের ছয়দিন ট্রেইনিং করবো। ট্রেইনিং এর পঞ্চাশ ভাগ হচ্ছে নিজেকে আরো ফিট করার জন্যে আর বাকী পঞ্চাশ ভাগ হচ্ছে শরীর-মনের ভেতর থেকে রাগ বের করে দেয়ার জন্যে। আমার মনে আছে, ইডেন গার্ডেনে এক বিকেলে মাঠের চারপাশে কুড়ি রাউন্ড চক্কর দিয়ে ফেলেছি দৌড়ে। শেষের পাঁচ বা ছয় ল্যাপ আমি কিভাবে দৌড়েছি আমি জানিনা, অনেকটা অতোপাইলটের মতো শরীর দৌড়েছে।

নিজের ভাবনা নিয়ে এতোটাই মশগুল ছিলাম যে কতোটা দৌড়েছি আমি ভুলেই গেছি। আমার ট্রেইনার গৌতম রায় এর কাছে আমি কৃতজ্ঞ, তাঁকে অনেক ধন্যবাদ জানাই, মানুষটাকে যখন দরকার তখনই পেয়েছি, কোন দিন রাতের ব্যাপার নেই। এরকম শক্ত ট্রেনিং এর পর দেখলাম কোনরকম ব্যাট হাতে নেয়া ছাড়াই শরীরের ভর কমেছে প্রায় নয় কেজি।

অভাবনীয় একটা পরিস্থিতি। আমার মন তখন ত্রিধাবিভক্ত। মনের একটা অংশের নিজের ক্ষমতার উপর প্রচন্ড বিশ্বাস। একটা অংশ আমার দলে ফেরা নিয়ে একেবারেই অনিশ্চিত আর বাকী অংশটা দেখতে পাচ্ছে ভারতীয় দলের প্রতিটা জয়ে নিজের দলে ঢোকার দরজা আস্তে আস্তে আটকে যাচ্ছে।

এর মাঝে দেখতে পেলাম দলের দুএকজন মিডিয়ায় আমার দলে অন্তর্ভূক্তির সপক্ষে কথা বলছেন। এইসব সেই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কোচ একেবারেই ভালোভাবে নেন নি, তাদেরকে বিসিসিআই মৌখিক ভাবে সতর্ক করে দিলো এবং একজনকে একেবারে লিখিত কারণ দর্শাও নোটিশ। এই মানুষগুলোর বক্তব্য আমাকে আশাবাদী করে তুললেও বুঝতে পারছিলাম না ওদের টেক্সট করাটা ঠিক হবে কিনা। কিংবা ফোন করে ধন্যবাদ জানাবো কিনা। পুরো ব্যাপারটা কেমন অবাস্তব অবাস্তব লাগছিলো।

এর মাঝে চলে এলো চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। আয়োজক দেশ ভারত। এই টূর্নামেন্টটা হচ্ছে সেই টূর্নামেন্ট যাতে আমার পারফরমেন্স ঐ সময় দলে থাকা যেকোন খেলোয়াড়ের চাইতে সম্ভবত ভালো ছিলো। তার পরেও, অনেকটা অনুমিতভাবেই আমাকে দলে ডাকা হলোনা। নিজের দেশের মাটিতে খেলা হচ্ছে, সেখানে আমি খেলতে পারছিনা, এরচাইতে কষ্টের অনুভূতি আর হয় না। তখন রঞ্জি ট্রফিতে বাংলার দলকে নেতৃত্ব দেয়ার মাঝেই আমার ক্রিকেট সীমাবদ্ধ। অর্ধেক ফাঁকা গ্যালারীর সামনে খেলাটা কঠিন, তার উপর যেসব হোটেলে থাকতে হচ্ছিলো তাতে স্বস্তিদায়ক পরিবেশের চাইতে অস্বস্তিটাই বেশি, আর মানের দিক থেকে রঞ্জি ট্রফি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মানের চাইতে কয়েক আলোকবর্ষ পেছনে।

এর মাঝে ভারতের পেপসি কোম্পানির বস এর কাছে থেকে কল পেলাম একটা বিজ্ঞাপনের জন্যে। বিজ্ঞাপন আবার তৈরী করা হবে আমার তখনকার টালমাটাল অবস্থা নিয়ে। তিনি বললেন যে তিনি কখনোই দলে শুধুমাত্র একজন খেলোয়াড়ের অন্তর্ভূক্তির জন্যে গোটা দেশজুড়ে জনগনের মাঝে এমন উন্মাদনা দেখেননি। ব্র্যান্ড পেপসি আমাকে সমর্থন করেই একটা বিজ্ঞাপন বানিয়ে সাড়া দেশের জনগনের কাছে পৌঁছাতে চায়।

মানা করে দিলাম। এরকম নাটুকেপনার মাঝে আমি যেতে চাইনি। খুব আবেগমথিত কোন কথাবার্তা দিয়ে তৈরি কোন ক্যাম্পেইন দিয়ে কারো সহানুভূতি পেতে চাইনি যেখানে বলতে হবে, ‘ম্যাঁয় সৌরভ গাঙ্গুলি হুঁ। ভুলে তো নেহি? জো হুয়া কিঁউ হুয়া? ক্যায়সে হুয়া?’ এই বিজ্ঞাপনের শেষের লাইন আবার হচ্ছে ‘হাওয়া মে শার্ট ঘুমানে কে লিয়ে আউর এক মওকা মিল যায়ে?’ ধরণের আবেগীয় ব্যাপারস্যাপার।

পেপসি আমার এই মানা করে দেয়াটাও নিতে পারলো না। একদিন আইনি নোটিশ পেলাম যে ব্র্যান্ড হিসেবে আমার ইমেইজ ক্ষুন্ন না করে পেপসি যে কোন স্ক্রিপ্ট দিয়েই বিজ্ঞাপন বানানোর অধিকার রাখে। তো বিজ্ঞাপন টা আমাকে করতেই হলো। কিন্তু বিজ্ঞাপনে আবেগের ঐসব লাইনগুলো বলতে আমার প্রচন্ড অস্বস্তি হয়েছে।

বিজ্ঞাপন প্রচার পরবর্তী দর্শকদের প্রতিক্রিয়ার জন্যে আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। টিভিতে ঐ বিজ্ঞাপন যাওয়ার সাথে সাথেই চিঠি আর বার্তায় সয়লাব হয়ে গেলো। গাঙ্গুলী বনাম চ্যাপেল হয়ে গেলো জাতীয় বিতর্ক।

এরপর দক্ষিণ আফ্রিকায় একদিনের ক্রিকেটে ভারতীয় দলের ১-৪ ব্যাবধানে সিরিজ হারের পর থেকেই আমার দিকে জনসমর্থন বাড়তে লাগলো। দলের পারফরমেন্স সংসদে পর্যন্ত আলোচনা হলো। সেই আলোচনায় সংসদ সদস্যের সাথে হাজার মাইল দূরে থেকেও উত্তপ্ত বিতর্কে জড়িয়ে গেলো কোচ।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেষ্ট দলে আমার নাম আসতে শুরু করলো কিছু কিছু জায়গায়। যেদিন সিলেকশন হলো, সেদিন আমি ইডেন গার্ডেনে অনুশীলনে ছিলাম। মাত্রই রঞ্জি ট্রফিতে অ্যাওয়ে ম্যাচে পাঞ্জাবকে হারিয়েছে বাংলা। জয় উদযাপন এর জায়গায় একটু অনিশ্চয়তায় ভুগছিলাম আমি। নিজেকেই নিজে বলেছি, এবারেও যদি আমাকে উপেক্ষা করা হয়, তাহলে এবারেই শেষ। লড়াই করার যে তাড়নাটা নিজের ভেতর আছে, সেটা আর থাকবে না।

ঐদিন কোন ম্যাচ ছিলোনা। তারপরেও ইডেনের লন মিডিয়ার লোকে ভর্তি। দুপুরের দিকে সম্ভবত, কয়েকজন সাংবাদিক চিৎকার করে বললো, সৌরভ, আপনাকে দলে নেয়া হয়েছে। কিছুটা অবিশ্বাস আর কিছুটা আনন্দে আমি কেবল সাংবাদিক দের দিকে হাত উঁচিয়েছিলাম।

অবিশ্বাস্য এক অনুভূতি। একদম ছোট বাচ্চা অবস্থায় হাতে প্রথম চকলেটের একটা আস্ত বাক্স ধরিয়ে দেবার পর যেমন লেগেছিলো অনেকটা সেরকম। প্রচন্ড গভীর আনন্দের এক অনুভূতি। মনে হচ্ছিলো ভারতের হয়ে জাতীয় দলের ক্যাপ পেয়েছি আবার। গোটা শহরও আমার এই আনন্দ উদযাপন করলো।

এর মাঝে এক সাংবাদিকের ফোন পেলাম। ভদ্রলোক তখন দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ কভার করছেন। তার গলায় আমার আবার দলে ঢোকায় কোন আনন্দ কানে লাগলো না। তার বদলে তার গলায় শোনা গেলো শঙ্কা মেশানো উপদেশ, ‘নির্বাচিত হয়েছেন, খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু এই সিরিজেই ঢোকার জন্যে এতো পরিশ্রম কেন করছেন? বিশাল ভুল হচ্ছে কিন্তু। দক্ষিন আফ্রিকা এখন খুনে ফর্মে আছে। এর চাইতে ঘরের মাটিতে ওয়েষ্ট ইন্ডিজের সাথে দলে ফিরলেই তো হতো। অনেক নিরাপদ হতো আপনার ফেরা।’

এই কথায় আমার কোন সায় ছিলো না। দক্ষিণ আফ্রিকায় যাবার জন্যে আমি ছিলাম একেবারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমার যুক্তি খুবই সহজ এবং পরিষ্কার। আগামী তিন চার বছরের জন্যে যদি ভারতীয় দলে নিজের অবস্থান পাকা করতে চাই তাহলে দক্ষিন আফ্রিকার ঐ খুনে জায়গাতেই আমাকে পারফর্ম করতে হবে। ঐ সময়ে দক্ষিন আফ্রিকার কন্ডিশন খুবই কঠিন এবং দল হিসেবেও ওরা ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ার চাইতে শক্ত প্রতিপক্ষ। ম্যান্ডেলাল্যান্ডের উইকেট ও প্রচন্ড দ্রুতগতির। ডারবান এর মতো উইকেটে আছে নিখাঁদ বাউন্স। ওরকম কন্ডিশনে দক্ষিন আফ্রিকার বোলিং হচ্ছে বিশ্বের সেরা বোলিং লাইন আপ।

হয় এখন নয়তো কখনোই না, এরকম একটা অবস্থা তখন আমার জন্যে। এই সুযোগ কোনভাবেই হাতছাড়া হতে দেয়া যাবেনা। এরপরেই শুরু হলো আমার ভয়ংকর অনুশীলন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে বাংলা দলের সাথে অনুশীলনের পরই সোজা ইডেন গার্ডেনের ইনডোর প্র্যাকটিস হল। সেখানে শক্ত প্লাস্টিকের বল দিয়ে আলাদা অনুশীলন করেছি শুধু বাউন্স আর অতিরিক্ত গতির বল সামাল দেয়ার অংশ হিসেবে। সাথে আছে প্যারাস্যুট ট্রেনিং, শরীরকে ফিট রাখার জন্যে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম টেষ্টের আগে পচেফস্ট্রুম এ ওয়ার্ম আপ ম্যাচ ছিলো, গন্তব্য তাই ওখানেই। যাবার পথে বিমানে বেশ কয়েকজন টিভি ক্রু মেম্বারদের সাথে দেখা হলো। ইনারা কেউই ওয়ানডে ম্যাচ কভার করতে যান নি কিন্তু এখন যাচ্ছেন টেষ্ট কভার করতে, টিআরপি বাড়া নিয়ে কথা। খেলা তো এখন আর ভারত বনাম দক্ষিন আফ্রিকা নেই, খেলা হয়ে গেছে গাঙ্গুলি বনাম চ্যাপেল। আমি এরকম টা চাইনি।

জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টে স্থানীয় ম্যানেজার আর টেষ্ট দলের নতুন তিন সদস্য আমাকে রিসিভ করতে এসেছিলেন। ম্যানেজার বললেন, ম্যানেজমেন্ট আমাকে এয়ারপোর্ট থেকেই সোজা প্র্যাকটিসে যেতে বলেছে। বুঝে গেলাম, আমাকে চ্যালেঞ্জ জানানো শুরু হয়ে গেছে। তাতে কিছুই যায় আসে না।
বাবাকে সবশেষে কী বলেছিলাম সেদিন বিকেলে, তাও আমার মনে আছে, ‘এখনো আমার ক্রিকেট কে অনেক কিছু দেয়ার আছে।’

_______________

মূল: A Century Is Not Enough (Chapter 13) By Sourav Ganguly & Gautam Bhattacharya

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link