More

Social Media

Light
Dark

সৌরভ গাঙ্গুলি: ক্রিকেট রোম্যান্টিসিজমের সাথে আমার সেতুবন্ধন

৫২,৬২৪ রান, ৮৪৬ উইকেট আর ১১৫২ ডিসমিসাল। অসংখ্য সুখস্মৃতি আর পরিসংখ্যানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চার ক্রিকেটারের অবদান, হরভজন সিং, মহেন্দ্র সিং ধোনি, সৌরভ গাঙ্গুলি এবং সুনীল গাভাস্কার। 

বছরের সেই দশ দিন ফিরে এসেছে। জুলাই মাসের প্রথম দশ দিন। চার ভারতীয় ক্রিকেট কিংবদন্তীর জন্মদিন, যারা বিভিন্ন সময়ের সাপেক্ষে সর্বকালের সেরাদের মধ্যে অবশ্যই থাকবেন।

তাঁদের মধ্যে কে সবচেয়ে সেরা এ নিয়ে সারাদিন তর্ক করা যাবে, কিন্তু শেষমেষ তাঁদের কীর্তিগুলির সম্মানই বাড়বে আরো। 

ads

আট জুলাই সৌরভের জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে, তাঁর নেতৃত্ব, তাঁর ব্যাটিং, তাঁকে নিয়ে গড়ে উঠা বিতর্ক, তাঁর লিগেসি টিম এসব বারবারই বিভিন্ন জনের কলমে উঠে এসেছে। গ্রেট প্লেয়ারদের অসাধারণত্ব খেলার প্রতি অনুরাগ ধরে রাখে, কিন্তু কিছু কিছু চরিত্র খেলায় নিমগ্ন হতে বাধ্য করে, খেলাটির প্রেমে পড়তে বাধ্য করে। 

আমার কাছে সৌরভ গাঙ্গুলি ছিলেন সেরকম একজন ব্যক্তিত্ব।

সৌরভ আর তাঁর মাঠের শ্রেষ্ঠত্বের গল্প ছাড়িয়ে, এটি মূলত আমার নিজস্ব কাহিনী, যে কিনা ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট পরিসংখ্যানের জগতে মজে আছে, শেষকালে এসে এমন একজনের প্রতি নিজের সমস্ত আবেগ ঢেলে দিচ্ছে যে কিনা তাঁর মনের ছকে আঁকা গ্রেটেস্টের সংজ্ঞার  মধ্যে পড়ছে না। তবুও, তাঁকে ছাড়া ক্রিকেট আমার কাছে নিছকই একটা খেলা, আবেগ হয়ে উঠেনা।

একটু পিছনে ফিরে যাই, ১৯৯৫ এর নভেম্বর মাস, মুম্বাইয়ের ব্র্যাবর্ন স্টেডিয়াম।

যারা আমার বাবার মতো বাংলার ক্রিকেটকে ভালবাসতেন তাঁদের জন্য দিনটা ছিল হতাশার। উইলস ট্রফি জিততে তরুণ শচীন টেন্ডুলকারের নেতৃত্বে স্টার উইলস একাদশের বিপক্ষে বেঙ্গল টিমকে ৫০ ওভারে ৩০০ রান করতে হতো। 

১২৫ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে সে পথ কঠিন হয়ে উঠল।  কিন্তু পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এলেন এক লম্বা ছিপছিপে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান।

জাভাগাল শ্রীনাথদের বেধড়ক মেরে তুলে নিয়েছেন স্ট্রোকঝলমল এক সেঞ্চুরি। খেলার দুঃখ ভুলে বাবা স্ট্রোকগুলো নিয়েই মেতে উঠলেন, আমাকে ব্যাটিংয়ে ‘টাইমিং’-এর গুরুত্ব বোঝাতে লাগলেন স্ট্রোকগুলো দেখিয়ে। 

‘ইনি কি বিশ্বকাপ খেলবেন?’ আমার জিজ্ঞাসা।

‘তিনি ১৯৯২ সালে ভারতের হয়ে খেলেছেন। ঠিকঠাক চিন্তা থাকলে তাঁর ও রাহুল দ্রাবিড়ের থাকা উচিত।’

একজন ভারতীয়, একজন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান, একজন ডানহাতি বোলার – আমি সবসময় ভাবতাম, আমার গোত্রের লোকজন মানে আমার মত বাঁ-হাতি বড়ই বিরল। অন্তত আমার কলোনিতে কেউ ছিল না। ব্যাপারটা আমার মাথায় গেঁথে ছিল।

ব্রায়ান লারার ব্যাটিংতাণ্ডব দেখতে ভালবাসতাম কিন্তু সেটাও ছিল সীমিত। স্কুলছাত্রের রাত ৩-৪টা জেগে খেলা দেখার সাধ্যি থাকেনা। ভারতে আমার নায়ক ছিলেন বিনোদ কাম্বলি। তবে তা ছিল কিছু সময়ের জন্য। আমার প্রতীক্ষা ছিল ব্রাবর্ণে দেখা সেই যুবকের জন্য, তাঁর জাতীয় দলে স্থান পাওয়ার আশা। আমি তাঁর সাথেই নিজেকে মেলাতে চাইতাম। 

সে পর্যন্ত ক্রিকেটকে খেলার আনন্দে দেখেছি খেলেছি। মার্ভ হিউজ-ডেভিড বুন জুটি আমাকে মুগ্ধ করত, তাই তাঁদের বিপক্ষে চার বছর বয়সী এক বালকের খেলা উপভোগ করতাম। ১৯৯৬ সাল বিশ্বকাপ অব্দি আমি জানতাম টেন্ডুলকার বুঝি চার বছর বয়স থেকে জাতীয় দলে খেলছেন, দশ বছর বয়সে এই টুর্নামেন্ট খেলছেন এবং বিস্মিত হতাম। আসলে আমার বাবা রসিকতা করতেন আমার সাথে। আমি বিশ্বাস করতাম। কারণ, তিনি যাই বলতেন আমার কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য লাগত। যাইহোক ছোটবেলাকার বোকামির কথা তুলে রাখছি। 

সম্ভবত এটা একটা কারণ যে, আমি শচীনকে আপন করতে পারিনি। আমি ভাবতাম, আমার মতো একটা বাচ্চা কীভাবে ডোনাল্ড, ওয়াকারের গতি সামলাবে? কৌতূকের মায়া ছাড়াই, টেন্ডুলকার যে যাদু তৈরি করতেন, তা মানুষের চিন্তার বাইরে ছিল!

ডোনাল্ড আমাকে আরো ক্রিকেট নিয়ে স্মৃতি মনে করাচ্ছে। অ্যালান ডোনাল্ডের ব্যাটিং ছিল বিনোদন, আশায় থাকতাম কখন ডাক মারবে! ডাক মারার পর সেই ডাকের এনিমেশন আসত স্ক্রিনে, আর আমি চিৎকার করতাম ‘ডোনাল্ড ডাক’ বলে!  

তাঁর ব্যাটিং দক্ষতাকে ধন্যবাদ, সেই সময়গুলো মজার হয়ে উঠত তাঁর জন্য। উত্তেজনার মাঝে লক্ষ্য করছি আমি এখনো সেই বোকা বাচ্চাটার গল্পই বলে যাচ্ছি। 

ক্রিকেট আমার কাছে একটি খেলাই ছিল। আমার বাবার জন্যই যা সহ্য করতে হত। একটি ক্রিকেট ম্যাচ মানে একদিন টম এবং জেরি নেই, কখনও ‘জাঙ্গাল বুক’ মিস করাতো। কিন্তু শীঘ্রই চরিত্রগুলি আমার জগতে বিনোদনের উপাদান হিসেবে যুক্ত হতে লাগল। টেন্ডুলকার, লারা, ক্রো, ওয়ার্ন মাঝে মাঝে আনন্দ দিত। সব বাচ্চারাই এভাবে ভাবত কিনা জানিনা, কিন্তু আমি ওই চরিত্রগুলো নিয়ে ভাবতাম আর নিজের মত করে তাঁদের চিত্র তৈরি করে নিতাম। 

একদিন কলোনির ম্যাচে ওয়ার্নকে অনুকরণ করতাম তো পরের দিন চন্দরপলের ব্যাটিং কপি করছি। 

১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল আমার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। আমার ভারতের নায়ক কাম্বলি কাঁদতে কাঁদতে ড্রেসিংরুমে ফিরলেন। আমি হতে পারি নিনজা টার্টলসের রাফেল, জাঙ্গাল বুকের বাঘিরা, মাস্টার্স অব ইউনিভার্সের হিম্যান, ডাক টেলসের বুব্বা বা ডাব্লুডাব্লুএফ (এখন ডাব্লুডব্লিউই) এর ব্রাক হার্ট কিন্তু আমি ভারতীয় ক্রিকেটের কম্বলি নই। তাঁর প্রতিভার সম্মান করলেও নিজেকে তাঁর সাথে সম্বন্ধ করতে পারতাম না।

আমার অপেক্ষা ছিল স্বল্পস্থায়ী।

না, এটা শুধু লর্ডস না।  দীর্ঘ ইংল্যান্ড সফরটাই। 

গাঙ্গুলি ও দ্রাবিড়কে বিশ্বকাপের পর প্রথম টেস্টে জন্য ডাকা হলো। ইএসপিএন ভারতীয় বনাম ইংলিশ কাউন্টি ম্যাচ প্রচার করল। আমি তখন নতুন দুই নায়ককে পেয়ে গেছি – প্রায় একইরকম অন্তর্মুখী। এবং এর একজনের মাঝে আমি নিজেকে দেখতে শুরু করি। বাবার কথার অনুরণন পেলাম, সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে হয়তো ১৯৯৬ বিশ্বকাপে গাঙ্গুলি এবং দ্রাবিড় বিশ্বকাপ খেলতেন।

বিশ্বকাপ শেষে একটা আশা মজবুত হতে লাগল – সম্ভবত এই দুজনেই ১৯৯৯ বিশ্বকাপে নিজেদেরকে এই মাটিতে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠবেন।

আমার ১৯৯৬ এর গরমের ছুটি কাটে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট দেখে দেখে। আমি খেলাটা বুঝতে অনেক কিছুর সাহায্য নিয়েছি। আমার ওয়ার্ল্ড বুক এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে আরও শিখেছি।

১৯৯৬ সালের মে-জুনের পরে আমি নিজেকে ভারতীয় ক্রিকেটের সাথে সম্পৃক্ত করতে শুরু করি। এটি আর কেবল একটি খেলা রইল না, ক্রিকেটে ভক্তির শুরু তখন থেকে। আমার মোটা মোটা খাতা থাকত বিভিন্ন ম্যাচের পরিসংখ্যান লিখতাম, এমনকি কলোনিরও। 

পাড়ার বাচ্চাদের মধ্যে আমি সম্ভবত একমাত্র বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান এবং ডান হাত দিয়ে বোলিং করেছি। যদি কেউ সেই ‘উল্টো’ শব্দটি বলতো, আমি ইএসপিএন দেখতে বলতাম।

লর্ডস, ট্রেন্টব্রিজে সৌরভের সেঞ্চুরি তাঁকে জাতীয় নায়ক করে তুলেছিল। তবে আমার আশানুরূপ কোন চমক সেটি ছিল না। 

বাঙালি সৌরভের বাংলা জয়টা খুবই স্বাভাবিক। আমাদের মায়ের ভাষা এক হলেও সেটা আমাকে ছুঁয়ে যায়নি। মুম্বাইতে আমার বেড়ে ওঠা, বাংলায় কখনো না থাকিনি – তাই আমাকে বাংলার আবেগ স্পর্শ করত না কিংবা হয়ত সেটা বোঝার মত চালাক ছিলাম না।

কখনও জেদ উঠত ‘দ্য ওয়াল’-এর মত ডিফেন্স করার। আমি দীর্ঘদিন ক্রিকেট কোচিং থেকে দূরে ছিলাম। হঠাৎই খেলার ইচ্ছা জেগে উঠল। গাঙ্গুলি আমাকে আমার প্রথম ক্রিকেট কিট এবং পরে কোচিং সেশনের দিকে ঠেলে দিলেন।

আমাদের যাত্রা সমান্তরাল হলো। গাঙ্গুলি কি নিখুঁত ছিলেন আদর্শ হিসেবে? আমিও তো নিখুঁত নই। আমি চেষ্টা করেছি এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকে অনুকরণ করতে চেয়েছি। আমি স্পিনার থেকে মিডিয়াম পেসার হয়ে গেছি, ১৯৯৭ সালে তাঁর পাকিস্তান সিরিজে মিডিয়াম পেসে বীরত্বের পর। 

এখানে একটা তথ্য না জানালেই নয়। ১৯৯৭ সালে টরন্টোয় পাকিস্তানের বিপক্ষে গাঙ্গুলির বীরত্বে ভারত তাঁদের প্রথম সাহারা কাপ জিতেছিল। তিনি ওয়ানডেতে টানা চার ম্যাচ সেরার পুরষ্কার পেয়ে রেকর্ড গড়েন।

১৯৯৮ তে, আমি আমার দলের একমাত্র পাঁচ ফুটি হয়েও অধিনায়ক ছিলাম। খারাপ ফিল্ডার হিসাবে শেষ করেছিলাম। আমি  গর্বিত ছিলাম না, তবে ক্রিকেটে আমার এই গভীর ভালবাসা সৌরভের কারণেই জন্মেছিল এবং কয়েক বছর ধরে আমি অন্যান্য নায়কদেরও খুঁজে পেয়েছি। যেমন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট।

আমি গাঙ্গুলিকে আইডল মেনেছি। আবার আমি তার অনেক কথা প্রত্যাখ্যান করেছি। আমি আমার বাবা-মায়ের সাথেও তাই করেছি। আরেকটি বৈশিষ্ট্য যা লোকটি আমাকে শিখিয়েছে, সঠিক চিন্তা নিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকা। 

এটি শ্রদ্ধার কথা, অন্ধ ভক্তি নয়। তার বিশ্বাস নিজের বিশ্বাসে লীন করেছি, এবং তা আমাকে হতাশ করেনি। আমি তাঁর নেতৃত্বগুণকে যুক্ত করেছি আমার যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা আর নির্ভীকতার সাথে। এই দর্শন আমাকে সাহায্যই করেছে। 

কলেজের দিনগুলিতে, পেশাগত বা এমনকি নেতৃত্বের অল্প সুযোগেও, আমি প্রায়ই এভাবে ভাবতাম যে গাঙ্গুলি এখানে থাকলে কি করতেন। আমি তাঁর নেতৃত্বের স্টাইলটি পেশাদারভাবে গ্রহণ করব, দলের সদস্যদের বিকাশ করা, তাদের কঠোর পরিশ্রমে মূল্য দেওয়া, তাঁদের প্রতি মনপ্রাণ থাকা। আজকাল, আমি এটিতে ধোনির চিন্তাও যুক্ত করি। 

উপযুক্ত লোকটাই বিসিসিআই সভাপতি, এমন একটি ক্রিকেট বোর্ড চালাচ্ছেন যারা বিশ্বজুড়ে এই খেলার অন্যতম হর্তাকর্তা। তার মাঠের অর্জনগুলি একপাশে রেখে, অন্য একটি প্রশংসনীয় গুণ হ’ল তার কাজের নীতি। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান গেমের আগে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ইডেন গার্ডেনে জমা পানি পরিষ্কারে তাঁর মাঠে নেমে গ্রাউন্ডসম্যানদের সাথে কথা বলা ভাল লেগেছিল। প্রশাসক হিসেবে সফলভাবেই খেলা মাঠে নামিয়েছিলেন।

৪০-এর মাঝামাঝি থাকা এই ভদ্রলোক ক্রিকেট প্রশাসন থেকে শুরু করে শো উপস্থাপনা, ব্যবসা পরিচালনা করা পর্যন্ত – কত কিছু করে যাচ্ছেন, তাঁর এই মনোবল মানুষকে অনুপ্রেরণাই দিয়ে যায়। তিনি যখন কথা বলে, সবাই শুনতে বাধ্য কারণ কথায় যে আলাদা ওজন থাকে। 

তিনি যেখানেই যান অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে থাকেন। আক্ষরিক হিসাবে ফ্যান শব্দটা খুবই ছোট।

এক দশক ধরে ক্রিকেট আমার খাদ্যর সমতুল্য, আজও আমার অক্সিজেন।  আমার এখানে আসার জন্য একটা সেতুর দরকার ছিল, সেতুটির নাম ‘সৌরভ গাঙ্গুলি’। এবং আমি তাঁর কাছে চির কৃতজ্ঞ। 

সমালোচকরা তাঁকে নিয়ে বিতর্ক করবেন, স্কেল দিয়ে মেপে মেপে তাঁর মহত্ত্বকে পরিমাপ করবেন।  কিন্তু, তিনি আমার জীবনে এমন এক অভ্যাস যা আমি ধরে রাখতে পারলে জীবনকে ধন্য মনে করব। সৌরভ গাঙ্গুলি একটি আবেগ, একটি অভ্যাস, শখ, একটি মাপকাঠি। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link