More

Social Media

Light
Dark

কার্লোস পুয়োল, ফুটবলের টারজান

কোঁকড়ানো আর ঝাঁকড়া চুলের জন্য ‘টারজান’ তখন বিশ্বব্যাপী পরিচিত। নব্বই দশকে টনি গোল্ডওয়াইন অভিনীত এ চরিত্রের প্রতি সে সময়ের বেশিরভাগ তরুণ-তরুণীদেরই একটা তীব্র আকর্ষণ কাজ করতো। অনেকে তো আবার বড় চুল রেখে নিজেকে ‘টারজান’ নামেই পরিচয় দিতে পছন্দ করতো। বাচ্চাদের খেলাধুলার প্রাঙ্গনেও উঠে আসতো ‘টারজান’ এর নাম। বিশ্বখ্যাত এ চরিত্রের ক্রেজ এমন এক পর্যায়েই চলে গিয়েছিল যে, সে সময়ে ‘টারজান টারজান’ নামে একটা খেলারও চল শুরু হয়ে গিয়েছিল।

তো, এভাবে ‘টারজান’ নাম ছড়িয়ে পড়েছিল পেশাদার ক্রীড়াঙ্গনেও। ঝাঁকড়া চুলের কোনো খেলোয়াড়ের উপস্থিতি মিললেই হলো। ব্যাস। গণমাধ্যমের  দেওয়া ‘টারজান’ নামে সমগ্র বিশ্বে পরিচিতি পেয়ে যেতেন তিনি। ফুটবল বিশ্বে নব্বই দশকের শেষ দিকে ঠিক এমনই এক ‘টারজান’-এর দেখা মিলেছিল। যিনি সেই কৈশোর থেকে ক্যারিয়ারের শেষ অবধি সতীর্থ কিংবা পুরো ফুটবল বিশ্বের কাছে একজন ‘টারজান’ নামেই পরিচিতি পেয়ে গেছেন। তিনি স্পেন ও বার্সার সাবেক ডিফেন্ডার কার্লোস পুয়োল।

স্পেন কিংবা বার্সার ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ডিফেন্ডারের তালিকায় প্রথম সারিতেই থাকবেন কার্লোস পুয়োল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কার্লোস পুয়োলের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল একজন গোলরক্ষক হিসেবে। নিজ শহরের ক্লাব লা পোবলা ডি সেগুরের হয়ে ফুটবলে প্রথম হাতেখড়ি। গোলরক্ষক হিসেবেই এ ক্লাবের নিয়মিত মুখ ছিলেন তিনি। তো একদিন হঠাৎ করে, একজন স্ট্রাইকারের সঙ্কট হলো। কী মনে করে, কার্লোস পুয়োল মেটালেন সেই সঙ্কট। গোলরক্ষক থেকে হয়ে গেলেন পুরোদস্তুর স্ট্রাইকার।

ads

ব্যাস। এরপরেই গোলরক্ষক হিসেবে পুয়োলের ক্যারিয়ারে যবনিকাপাত। রক্ষণভাগ থেকে হয়ে উঠলেন আক্রমণভাগের খেলোয়াড়। যদিও পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারে বার্সার হয়ে পরবর্তীতে সেই রক্ষণভাগেই আবার ফিরে এসেছিলেন তিনি। তবে সেটি গোলরক্ষক হিসেবে নয়, কখনো রাইট ব্যাক, কখনো সেন্টার ব্যাক কখনোবা আবার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে।

১৬ বছর বয়সে পুয়োল ভর্তি হন বার্সেলোনার লামাআসিয়াতে। যদিও পুয়োলকে নিয়ে প্রথমে তেমন কোনো আশাই করেননি তাঁর বাবা। পুয়োলের প্রবল আগ্রহের কারণেই তাঁকে বার্সেলোনার এ অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করেন তিনি। ইউরোপের ফুটবলে যে তাঁর ছেলে টিকবেন না, এমন ভবিষ্যদ্বাণীও করে ফেলেছিলেন পুয়োলের বাবা। তবে বাবার সে ভবিষ্যদ্বাণী পরবর্তীতে মিথ্যে প্রমাণ করেছিলেন পুয়োল। মাত্র বছর চারেকের মধ্যেই বার্সেলোনার মূল দলে প্রবেশ করেন তিনি। আর এর এক বছর পরেই স্পেন জাতীয় দলে পা পড়ে পুয়োলের।

১৯৯৯ সালে বার্সেলোনার হয়ে অভিষেক হয় কার্লোস পুয়োলের। তার আগ অবধি, রাইট উইঙ্গার হিসেবে খেলতেন পুয়োল। কিন্তু কী মনে করে, সে সময়ের বার্সা কোচ লুই ফন গাল, পুয়োলকে নিয়ে চালালেন এক পরীক্ষা। রাইট ব্যাকে নিয়মিত খেলা মাইকেল রেইজগারের জায়গায় মাঠে নামালেন পুয়োলকে। আর এতেই ক্যারিয়ারে নতুন এক পথ উন্মোচিত হয়ে যায় পুয়োলের। রাইট উইঙ্গার থেকে রাইট ব্যাক হয়ে ওঠেন তিনি।

আক্রমণ ভাগ থেকে সরাসরি রক্ষণভাগ সামলানোর দায়িত্ব— পুয়োলের তখন অভিজ্ঞতা ছিল না বললেই চলে। কিন্তু বার্সেলোনার হয়ে প্রথম মৌসুমেই বেশ নজর কাড়েন তিনি। কোচের আস্থার প্রতিদান দেন দারুণভাবে। এরপর থেকেই বার্সার হয়ে স্থায়ী পথচলা শুরু পুয়োলের।

ক্লাব ফুটবলে ১৫ বছর কাটিয়েছেন। আর এ দীর্ঘ সময় জুড়ে এই একটি ক্লাবেই খেলেছেন তিনি। সেদিনের কৈশোর পেরোনো পুয়োল পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন বার্সার ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক। বার্সার হয়ে ৬ টি লা লিগা, ২ কোপা দেল রে আর ৩ টি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতে বার্সার হয়ে সর্বজয়ীদের কাতারে প্রথম নাম লেখান তিনি।

২০০৪ সালে সর্বপ্রথম বার্সার হয়ে অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড হাতে পান কার্লোস পুয়োল। আর এর পরের মৌসুমেই বার্সেলোনাকে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপ জেতান তিনি। এরপর ২০০৮-২০০৯ মৌসুমে বার্সেলোনা যেবার প্রথমবারের মতো ট্রেবল জিতল, সেবারও বার্সেলোনাকে আর্মব্যান্ড হাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।

ক্লাব ক্যারিয়ারে দারুণ সফল থাকা কার্লোস পুয়োল স্পেনের সোনালি প্রজন্মেরও অন্যতম সদস্য ছিলেন। ২০০৮ ইউরো এবং ২০১০ বিশ্বকাপ, দুটি শিরোপা জয়ের পথেই রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ২০১০ বিশ্বকাপে স্পেন ফাইনালে উঠেছিল তো তাঁর করা গোলের সৌজন্যেই।

জার্মানির বিপক্ষে ৭৪ মিনিটে করা সেই বুলেট গতির হেড তো এখনো আলোচনার খোরাক জোগায়। স্পেনের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র বিশ্বকাপ জয়ের গল্পে সেই হেডের পিছনেও রয়েছে দারুণ এক গল্প।

মূলত সে ম্যাচের প্রথমার্ধে জার্মানির রক্ষণভাগে মুহুর্মুহু আক্রমণ করার পরে কাঙ্ক্ষিত গোলের দেখা পাচ্ছিল স্পেন। বেশ কয়েকটা কর্নার পেয়েও কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছিলে স্প্যানিশ ফুটবলাররা। এর পিছনে অন্যতম কারণ ছিল, জার্মান ফুটবলারদের উচ্চতা। মূলত তাদের ডিফেন্ডারদের উচ্চতা বেশি হওয়ায় ঠিকঠাক হেড করার মতো জায়গায় পাচ্ছিল না স্পেনের ফুটবলাররা।

প্রথমার্ধের বিরতিতে একটা কৌশল বাতলে দেন পুয়োল নিজে। তিনি প্রথমে জাভিকে কর্নার থেকে বল ডি বক্সের কিছুটা দূরে হাওয়ায় ভাসানোর পরামর্শ দেন। যাতে করে কেউ আনমার্ক অবস্থায় থেকে হেড করতে পারে। পুয়োলের এমন কৌশল বেশ মনে ধরল জাভির। তিনি কোচ ভিসেন্তে দেল বস্ককেও জানালেন। বস্কও সাঁয় দিলেন তাতে।

যেই ভাবা সেই কাজ। ম্যাচের ৭২ মিনিটে কর্নার নেন জাভি। তিনি পুয়োলের বুদ্ধিতে বল উড়িয়ে দিলেন জার্মানির ডি বক্সের একদম মাঝামাঝি। পুয়োল তখনও বক্সের বাইরে, কেউ তাই তাঁকে মার্কও করেনি৷ তো এ সময়ে বল বক্সে হাওয়ায় ভাসার সাথে সাথেই নিজের খেল দেখান পুয়োল। জার্মানদের আকস্মিকতায় ডুবিয়ে ছুটন্ত ট্রেনের মতো দৌঁড়ে আসেন পুয়োল।

এরপর লাফিয়ে ওঠেন বাতাসে। আর দেহের সমস্ত শক্তি নিয়ে আসেন মাথায়। বলে ঠিকঠাক মাথা লাগিয়ে দিলেন এক বুলেট হেড। ব্যাস, বল চলে যায় জালের দিকে। ম্যানুয়েল ন্যুয়ারের কোনো প্রচেষ্ঠাই বলকে জালের ছোঁয়া পাওয়া থেকে আটকাতে পারেনি। নিখুঁত এক পরিকল্পনায় দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ে জার্মান গোলবারে গোল আদায় করে নেন কার্লোস পুয়োল। আর পুয়োলের একমাত্র গোলেই ফাইনাল নিশ্চিত হয় স্পেনের। এরপরের গল্প তো সবার জানা। ফাইনালে ডাচদের হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে নেয় স্পেন।

বিশ্বকাপের পর ইনজুরিতে পড়েন পুয়োল। আর এই ইনজুরিই কেঁড়ে নেয় পুয়োলের পরের অধ্যায়। বিশ্বকাপের পর আবারো ২০১২ ফুটবলে শিরোপা জিতেছিল স্পেন। তবে ইনজুরির কারণে সে সাফল্যযাত্রায় অংশীদার হতে পারেননি তিনি। একই সাথে বার্সেলোনার সাথে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চুক্তি থাকলেও ক্রমাগত ইনজুরির কারণে ২০১৪ সালে শেষমেশ তিনি ফুটবলকে বিদায় বলতে বাধ্য হন।

কার্লোস পুয়োলের সাফল্যমণ্ডিত ক্যারিয়ারে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো তাঁর নেতৃত্ব আর সতীর্থদের প্রতি তীব্র ভালোবাসা। বার্সেলোনার হয়ে এক টানা প্রায় ১০ বছর অধিনায়কত্ব করেছেন। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি ছিলেন দলের সবার চোখের মণি। দলের প্রায় সব খেলোয়াড়কে তিনি আগলে রাখতেন একজন বড় ভাইয়ের মতো।

২০০৭ সালে একবার স্যামুয়েল এতো, রোনালদিনহো আর রাইকার্ডের মধ্য সাবস্টিটিউট করা নিয়ে ঝামেলা বেধেছিল। কিন্তু পুয়োল তা মিটিয়ে দিয়েছিলেন একদম ‘জলবত তরলং’ এর মতো। এ ছাড়া রিয়ালের হোম গ্রাউন্ড বার্নাব্যু তে একবার এল ক্লাসিকো চলাকালীন সময় পিকেকে গ্যালারি থেকে একটা লাইট ছুঁড়ে মারা হয়েছিল। এমতাবস্থায় পিকের সাথে গ্যালারিতে থাকা দর্শকদের সাথে দ্বন্দ্বে মাঠ গরম হতেই পারতো। কিন্তু সেখান থেকে মাঠে শান্তি বজায় রাখতে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন পুয়োল। একটা সময় পর, পুয়োলকে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে ভদ্র ফুটবলার হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন পিকে।

পুয়োলের আরো মহানুভবতার উদাহরণ রয়েছে। ২০১০ সালে বার্সেলোনার বিপক্ষে গাম্পার ট্রফি খেলতে ন্যূ ক্যাম্পে এসেছিল এসি মিলান। তো এসি মিলানের সেই দলে ছিলেন বার্সার এক সময়কার প্রাণভোমরা রোনালদিনহো।

পুয়োল সেবার তাঁর বহুদিনের সতীর্থ রোনালদিনহোর প্রতি সম্মান জানিয়েছিলেন একদম নিজস্ব ধরনে। এসি মিলানকে হারিয়ে সেবারের গাম্পার ট্রফি জিতে নেয় বার্সেলোনা। তবে ট্রফি গ্রহণ করার সময় পুয়োল ট্রফিটা হাতে তুলে দিয়েছিলেন রোনালদিনহোকে। ন্যু ক্যাম্পে আসা দর্শকরা সেদিনের মুহূর্তে এতটাই ভেসে গিয়েছিল যে, করতালি বন্যায় সে মুহূর্তটি হয়ে উঠেছিল রোনালদিনহো-বার্সার পূনর্মিলনীর দারুণ এক মঞ্চ।

সতীর্থ কিংবা প্রতিপক্ষ- সবার সাথেই পুয়োলের আচরণ সব সময়ই ছিল নমনীয়। ম্যাচে অনেক সময় উত্তাপ ছড়ালেও সতীর্থদের সেখান থেকে এক প্রকার নিজেই শান্ত করতে উদ্যত হতেন তিনি। আর এসব গুণাবলিই তাঁকে অনন্য করে তুলেছিল।

পাওলো মালদিনি, ফ্রেঞ্জ বেকেনবাওয়ার কিংবা রোমারিওর মতো প্রতিভাবান ডিফেন্ডার হয়তো নন কার্লোস পুয়োল। তবে দলের প্রতি তাঁর দারুণ নিবেদন, শ্রম তাঁকে সেরাদের কাতারে ঠাই দিয়েছিল ঠিকই। তিনি বার্সেলোনার হয়ে এসেছিলেন একজন টারজান হিসেবে। আর এই টারজানের বদৌলতেই বার্সা পেয়েছিল সোনালি এক অধ্যায়। বার্সা ছেড়ে চাইলেই অন্য কোনো ক্লাবে গিয়ে ক্যারিয়ার কিছুটা এগোতে পারতেন। কিন্তু শুরু করেছেন ঐ ন্যূ ক্যাম্পে, শেষও করেছেন ঐ ন্যূ ক্যাম্পেই। এক ক্লাবেই কাটিয়েছেন ক্যারিয়ারের ১৫ টা বছর। ঝাঁকড়া চুলের টারজান হয়ে বিশ্ব ফুটবল কাঁপিয়েছেন নিরব আগ্রাসনে।

ডিফেন্ডারদের নাকি নির্দয় হতে হয়, নির্মমতা দেখাতে হয়। কিন্তু সেই সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছিলেন কার্লোস পুয়োল। বছরের পর বছর বার্সা আর স্পেনের রক্ষণভাগ সামলেছেন একদম নিজস্ব একটা ধরনে। প্রতিপক্ষের কাছে ত্রাস ছিলেন ঠিকই, তবে তার মধ্যে ছিল না কোনো অহেতুক রেষারেষি কিংবা বৈরিতা। বরাবরই শান্তিপ্রিয় এক চরিত্রের নাম কার্লোস পুয়োল।

টেলিভিশনের পর্দার টারজান চরিত্রে অভিনয় করেছেন অনেক অভিনেতা। তবে সর্বপ্রথম এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জনি ওয়েসমুলার। বাস্তব জীবনে যিনি যে জায়গাতেই হাত দিয়েছেন সোনা ফলিয়েছেন সেখানেই। ১৯২০-এর দশকে বিশ্বের সেরা সাঁতারু হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। এক অলিম্পিকেই তাঁর যে কীর্তি, সেটিই তাঁকে ইতিহাসে অমর করে রাখার জন্য যথেষ্ট। অলিম্পিকে ৫টি স্বর্ণ ও ১টি ব্রোঞ্জসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ৫২ বার এবং ৬৯ বার বিশ্বরেকর্ড করা রেকর্ড আছে তাঁর।

জনি ওয়েসমুলারের মতো ফুটবল নামক পৃথিবীতে টারজান হলেন কার্লোস পুয়োল। পৃথিবীতে ঝাঁকড়া চুলে অনেক ফুটবলার এসেছেন। কিন্তু কার্লোস পুয়োলের মতো হতে পারেননি কেউ। স্পেনের হয়ে যিনি সর্বজয়ী, বার্সার হয়েও ঠিক তেমনটাই। তিনি ফুটবলের টারজান, কার্লোস পুয়োল।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link