More

Social Media

Light
Dark

টেম্বা বাভুমা ও দক্ষিণ আফ্রিকা, দ্য কিউরিয়াস কেস

আজ থেকে ঠিক বত্রিশ বছর আগে, জগমোহন ডালমিয়া আর আলি বাখারের সখ্যের ভিত্তিতে দক্ষিণ আফ্রিকা এই নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই একুশ বছর পরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে আসে এবং এই কলকাতার বুকেই আত্মপ্রকাশ করে।

মনে আছে, ক্লাইভ রাইস, অ্যালান ডোনাল্ড, পিটার কার্স্টেন, অ্যাড্রিয়ান ক্যুইপারদের বাসের সঙ্গে সঙ্গে উল্টোডাঙা থেকে বেলেঘাটা পর্যন্ত সাইকেল চালিয়ে গেছিলাম। সারা রাস্তা জুড়ে মানব শৃঙ্খল। স্বাগত জানালো গোটা কলকাতা হৃদয় দিয়ে।

ছেলেবেলা থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিদ্রোহী ট্যুর, রিচার্ডসের ব্ল্যাংক চেক ফিরিয়ে দেওয়া, লরেন্স রো’র নেতৃত্বে কালীচরণ, এজরা মোস্লে, সিল্ভেস্টার ক্লার্ক, বার্নার্ড জুলিয়েনদের বিশ্বনিন্দিত হওয়া সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা ছিল। ধারণা ছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে কীভাবে পিটারমারিৎজবার্গে মান্য টিকিট থাকার পরেও ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়।

ads

ধারণা ছিল, আপামর বিশ্বের বঞ্চনার বিরুদ্ধে জ্বলন্ত বিদ্রোহ নেলসন ম্যান্ডেলাকে ২৭ বছর ধরে পচিয়ে মারার উদ্দেশ্যে জেলে রেখে দেওয়া হয়। পি ডবলু বোথা, এফ ডবলু ডি ক্লার্ক। এসব পেরিয়ে কীভাবে একদম নয়ের দশকের মুখে ম্যান্ডেলা মুক্ত হন এবং তারপর একটা নতুন দেশের জন্ম হয়।

এই ধারণাটা অবশ্য ছিল না, ‘স্প্রিংবক’রা ‘প্রোটিয়াস’ কেন হয়ে গেল। সেটা পরে হয়! এটা নিয়েও তখন ভাবিনি যে রাইসদের দলটা ইউরোপীয়তে ভর্তি অথচ বলছে বর্ণবিদ্বেষ উঠে গেছে!

প্রথম অশ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকীয় টেস্ট খেলোয়াড় বাঁহাতি স্পিনার ওমর হেনরি। প্রথম কৃষ্ণকায় দক্ষিণ আফ্রিকীয় টেস্ট খেলোয়াড় মখায়া এন্তিনি। যাঁর সঙ্গে করমর্দন করতে গিয়ে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ম্যান্ডেলা, ভালো করে এক পাক ঘুরে এসে দেখে নিলেন। তারপর এন্তিনিকে বললেন, যে তোমার তো সারা দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো উচিত। তোমায় দেখে কালো মানুষরা আশার আলো দেখবে, যে এক শ্বেতাঙ্গ ক্রীড়াতেও আমরা কীভাবে আসতে পারি।

এই এন্তিনিই বলেছিলেন, কীভাবে ভরা ড্রেসিংরুমে তিনি একা থাকতেন। একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় কীভাবে বছরের পর বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে তাঁর সঙ্গে কেউ মিশত না।

দক্ষিণ আফ্রিকা খানিকটা বাধ্য হয়েই অশ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটারদের কোটা তৈরি করে। অ্যাশওয়েল প্রিন্স, গিবস, পল অ্যাডামসরা রাস্তা দেখান। ধীরে ধীরে দুমিনি, ভার্নন ফিলান্ডার, জুবেইর হামজা, কেশব মহারাজরা দক্ষিণ আফ্রিকা দলে জায়গা করে নিতে থাকেন।

আপাত দৃষ্টিতে দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ক্ষতি হতে থাকে এই অশ্বেতকায় কোটার কারণে। এভাবেই সাধারণ মানুষ দক্ষিণ আফ্রিকার ধীরে ধীরে পদস্খলনকে বর্ণনা করি। ২০২০তে সেই ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনেই ধীরে ধীরে সামনে আসে যে এন্তিনি, প্রিন্স প্রমুখরা কীভাবে দিনের পর দিন ধরে বর্ণবিদ্বেষমুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকাতেও বিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন।

মার্ক বাউচারের বিরুদ্ধে বর্ণ বৈষম্যমূলক মন্তব্যের অভিযোগ আসে। অভিযোগ আসে ২০০৫ কিংবা ২০০৬-এ জ্যাক ক্যালিস কেন জাতীয় সঙ্গীত বাজার সময় গাননি। এমন কি এবি ডি ভিলিয়ার্সও এই অভিযোগের বাইরে যাননি।

তখনই একটা কাজ করতে গিয়ে সামনে আসে নটিংহ্যাম কাউন্টিতে অধিনায়ক হিসাবে ক্লাইভ রাইসের দিলীপ দোশির সঙ্গে বিদ্বেষমূলক আচরণ। না, জনশ্রুতি অনুযায়ী দুর্দান্ত বল করেও দোশির পরের ম্যাচে বাদ যাবার সময় অধিনায়ক রাইস ছিলেন না। তবুও।

ওই কোটার অভিযোগটা প্রথম আসে যখন নিউজিল্যান্ডের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা ২০১৫ সেমি ফাইনালে হারে। বিশ্ববরেণ্য ডেল স্টেন শেষের দিকে প্রচুর রান দিয়ে ফেললেও সারা ম্যাচে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ইকোনমি রেট রাখা ভার্নন ফিলান্ডারের দিকেই সর্বাধিক অভিযোগ ধেয়ে আসে।

তেম্বা বাভুমা এবারে। তেম্বা আমাদের খিল্লির পাত্র। মার্কো জেনসনের পাশে দাঁড় করিয়ে আমরা বাভুমার উচ্চতা নিয়ে খিল্লি করি। বিশ্বকাপের খারাপ ফর্ম নিয়ে খিল্লি করি। কীভাবে বাবর আজমের থেকেও খারাপ অধিনায়কত্ব করেছেন বাভুমা সেই নিয়ে খিল্লি করি।

কোটার প্লেয়ার, কোটার ক্যাপটেন বলে খিল্লি করি। দায়িত্ব নিয়ে সেমি ফাইনালে হারিয়েছেন নাকি। নিজে ব্যাটে রান পাননি, মার্করমকে আক্রমণে আনতে বা সার্বিকভাবে স্পিনারদের আক্রমণে আনতে দেরি করেছেন ইত্যাদি।

বেশ কথা। তবে এই আমরাই আরেক অধিনায়ক জশ বাটলারের ফর্ম নিয়ে কিছু বলি না। সারা বিশ্বকাপে বাটলার ১৩৮ রান করেছেন এবং বাভুমা ১৪৫। অথচ এই বাভুমাই দেশের মাটিতে বিশ্বকাপের ঠিক আগেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজ জিতিয়েছেন নিজে রান করে।

এই বছরে ৫০ ওভারের ক্রিকেটে ওপেন করে বাভুমার একশর উপর স্ট্রাইক রেট রেখে প্রায় ৫০ গড় আছে। বাভুমা ২০১৬তে নিজের ৫০ ওভারের ক্রিকেটের অভিষেকে সেঞ্চুরি করেছিলেন। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসাবে টেস্ট সেঞ্চুরিও তাঁরই।

২০২১এ যখন কুইনটন ডিকক হাঁটু মুড়ে বসতে রাজ হন না ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’-এর প্রতীক হিসাবে, তখনই সমালোচনার ঝড় ওঠে। দক্ষিণ আফ্রিকা ড্রেসিংরুম দ্বিধাবিভক্ত, একে একে ঝুলি থেকে বৈষম্য ও বিদ্বেষের বেড়ালগুলি বেড়িয়ে পড়ছে। এই সময় বাভুমা দায়িত্ব নেন।

সীমিত ওভারে আগেই ছিলেন, ডিন এলগারের অধিনায়কত্ব ত্যাগের পর সামগ্রিকভাবে টেস্টেরও দায়িত্ব নেন। আসলে দ্বিধাবিভক্ত দক্ষিণ আফ্রিকীয় ড্রেসিংরুমকে একজোট রাখার দায়িত্ব বাভুমার। বাভুমা সেটা খুব ভালোভাবেই পালন করছিলেন। এই বিশ্বকাপের আগে বা বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার পারফরম্যান্স তাইই বলে।

অথচ একটা সেমি ফাইনালে টপ অর্ডার ব্যাটারদের সামগ্রিক ব্যর্থতার দায়ও তাঁকে নিতে হবে। বাভুমার ০ করা নিয়ে সবাই কথা বলবে, কিন্তু ক্যুইন্টন ডি ককের মতো ফর্মে থাকা ব্যাটারের ওরকম একটা ‘নাথিং’ শট নিয়ে কেউ কিছু বলবে না। সেটা তখন ঝুঁকি নিতে গিয়ে আউট হয়ে দাঁড়াবে।

হ্যাঁ, বাভুমার কিছু কিছু সিদ্ধান্ত প্রশ্নের মুখে পড়বে, সমালোচনার মুখে পড়বে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাঁর অধিনায়কত্ব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি ‘কোটার অধিনায়ক’ বলে দেওয়াটা অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই না।

সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ড যেভাবে ভারতের প্রথম ১০ ওভার সামলে তারপরেও ম্যাচে টিকে ছিল, সেটা দক্ষিণ আফ্রিকা করতে পারেনি। এই ম্যাচের টার্গেট স্কোর ছিল হয় তো ২৫০। সেটা দক্ষিণ আফ্রিকা সামগ্রিকভাবেই বুঝতে পারেনি। হ্যাঁ দল পরিচালকদের ব্যর্থতা, অধিনায়কের ব্যর্থতা। কিন্তু অযোগ্যতা নয়।

আজ দিনের শেষে এই রামধনু দেশের এক দক্ষ ডিপ্লোম্যাট ও ক্রিকেটার অধিনায়ককে কোটার অধিনায়ক বলতে গিয়ে আমাদেরই বৈষম্যবাদ সামনে চলে আসে। হ্যাঁ, ভারত একটি তীব্র বর্ণ বিদ্বেষী দেশ! যেখানে কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলোর নাচনকে দেবীজ্ঞানে পুজো করা হয়, অথচ ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি সর্বাধিক বিক্রিত বিউটি ক্রিম।

ফসসা হলে আমাদের জিভ দিয়ে নাল গড়িয়ে পড়ে, ইউরোপীয় বন্ধুদের আমরা সগর্বে দেখিয়ে বেড়াই, অথচ আফ্রিকান বন্ধুদের নিয়ে নাক সিঁটকানো থাকে।

বাভুমাকে সামগ্রিকভাবে দেখে সমালোচনা করলে ক্ষতি নেই। কিন্তু সেক্ষেত্রে বাটলারকেও করতে হবে কিন্তু। বাটলার আমাদের দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলেন আর বাভুমা নিজের দেশেই দল না পেয়েও অধিনায়ক! সে সব বলার সময় কিন্তু বাভুমার দক্ষিণ আফ্রিকার ড্রেসিং রুমে এবং সামগ্রিকভাবে অধিনায়ক হিসাবে গুরুত্বকে অস্বীকার করলে চলবে না।

সাফল্য ব্যর্থতা নিয়েই তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। টি২০র ক্ষেত্রে হয়তো তাঁর দলে থাকাটা দলটাকে একজোট করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু টেস্ট বা একদিনের ম্যাচে তিনি যোগ্যতা নিয়েই খেলে আসছেন। একটা ব্যর্থ বিশ্বকাপ দিয়ে তাঁর যোগ্যতার নির্ধারণ হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link