More

Social Media

Light
Dark

ম্যাক্সির ২০১* এখন তর্কাতীত! ব্যস, ফুল স্টপ!

ম্যাক্সির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অভিমানের। বলতে পারেন, অভিমান তো হয় কাছের মানুষদের সঙ্গে! হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। ম্যাক্সি আমার আপনজন। আমি তাকে ভালোবাসি। ইট ওয়াজ। কাউন্ড অব লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।

১১ বছর আগের এক রাতে প্রথম দেখলাম তাকে। তখন এরকম দাড়ি-টাড়ি তখন ছিল না। তরুণ এক অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান। শারজায় শাহিদ আফ্রিদিকে স্লগ সুইপে ছক্কা মারলেন। একটু পর সাঈদ আজমলকে ছক্কা মারলেন ইনসাইড আউট শটে এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে। অফ স্পিনারকে এক্সট্রা কাভার দিয়ে তুলে মারার খুব কঠিন।

আজমল তখন দুনিয়ার সেরা অফ স্পিনার (মূলত ভয়ঙ্কর চাক করতেন বলেই), তাবত ব্যাটসম্যানদের নাচিয়ে ছাড়েন। সেই আজমলকে অনায়াসে তুলে মারলেন ম্যাক্সি, শটের শেষ মুহূর্তে একটা একটা হাত সরেও গিয়েছিল ব্যাট থেকে। রমিজ রাজা ধারাভাষ্যে বলেছিলেন, ‘এক হাতে ছক্কা।’ মনে আছে, মাইকেল ক্লার্ক ড্রেসিং রুমে লাফিয়ে উঠে তালিয়ে দিচ্ছিলেন শটটা দেখে। আমি ম্যাক্সির প্রেমে পড়ে গেলাম।

ads

তার ক্যারিয়ারের তখন হাঁটি হাঁটি পা পা। সেদিন প্রথম ফিফটি করেছিলেন। ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলেছিলেন।

আমরা যারা ক্রিকেট নামক খেলাটাকে ভালোবাসি। কিছু ক্রিকেটারকে সাধারণ ভালো লাগার চেয়েও একটু বেশি ভালোবাসি, তাদের মনোজগত অন্যকেউ বুঝতে পারবে না। সেই ক্রিকেটারদের যখন খেলা থাকে, প্রতিটি ম্যাচে আবেগের কত স্রোত যে আমাদের হৃদয়ে বয়ে যায়, কত অনুভূতির দোলাচল, উচ্ছ্বাস-হতাশার কত রঙ ছড়ায় মনে। কেবল আমরাই জানি।

তিনি বিশালদেহী নন। রাসেল-পোলার্ডদের মতো পেশীবহুল নন। তাকে দেখলে দানবীয় কিছু মনে হয় না। কিন্তু কী অবিশ্বাস্য ব্যাট স্পিড, কী অসাধারণ ব্যাট সুইং!

খুব স্টাইলিশ নন, খুব দৃষ্টিনন্দন নন – তারপরও দারুণ মোহনীয়। অলস সৌন্দর্যেরই একটা ভিন্নরূপ… মনে হচ্ছে খুব ক্যাজুয়ালি ব্যাট চালিয়ে দিচ্ছেন, কিন্তু আসলে তা চাবুক!

ম্যাক্সিকে একটু বেশিই ভালোবেসেছি। বড় ভালোবাসায় কাঁটার আঘাতও বেশি। বারবার বিদ্ধ হয়েছি। ভালোবাসাটা ছাড়তে পারেনি। যে ম্যাচে তিনি প্রস্ফুটিত হন, সেটির সুবাস এত তীব্র, এত মোহনীয়, এতটা ঘোর লাগা যে সেই আবেশে আরও অনেক অনেক ম্যাচের যন্ত্রণা সয়ে ফেলেছি। এটা একটা অদ্ভূত নেশা – কবে আবার সেই সুবাস পাব!

পাই সেটা। তবে ম্যাক্সি মাঝেমধ্যে বড্ড তেরি করে ফেলেন। অভিমানগুলো ডালপালা মেলে শুধু। এখানে আমার সাংবাদিক বা পেশাদার সত্ত্বার কোনো প্রভাব নেই। স্রেফ ভক্তের ভক্তির জগত এটা।

২০১৫ বিশ্বকাপের সময়টায় তিনি মন ভরিয়ে দিয়েছিলেন অনেকটা। বিশ্বকাপের ঠিক আগে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৫ রানের ইনিংসের পর ৪ উইকেট, বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৭ ছক্কা, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫১ বলে সেঞ্চুরি। তবে ভারতের বিপক্ষে সেমিতে ছোট্ট ক্যামিও খেলে আউট হয়ে গেলেন, তখনও ১২ ওভার বাকি। মন খারাপ হয়েছিল, অজুতবারের মতো।

তার ফিল্ডিংয়ের আনন্দটাই কেবল সার্বক্ষনিক। কী অবিশ্বাস্য রিফ্লেক্স! এখানে কখনোই হতাশ করেননি। কিন্তু তার কাছে ভালোবাসার দাবি তো আরও অনেক অনেক বেশি!

একসময় আমার স্থির বিশ্বাস ছিল, ম্যাক্সি খুব ভালো টেস্ট ব্যাটসম্যান হবেন। ভালো বলতে তুমুল রান স্কোরার নন, তবে দারুণ কার্যকর, প্রভাববিস্তারি – মিডল অর্ডারের বিরেন্দর শেবাগ বা ম্যাথু হেইডেন হবেন, বা গিলির মতো আরেকজন। রাঁচির সেঞ্চুরিটি যখন করলেন, তার নিজের চেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলাম সম্ভবত আমি। তার পর আর জমল না। এখনও বিশ্বাস করি, এই টি-টোয়েন্টির ছোবল না থাকলে তিনি সত্যিই সেরকম হতেন।

সেই টি-টোয়েন্টিতেও তো কতশত অভিমানের গল্প জমা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া দলে যেমন-তেমন, আইপিএলে প্রচুর। শেবাগ তাকে নিয়ে কত যে অপমানজনক কথা বলতেন! এই শেবাগও খুব প্রিয় ছিল আমার। তার কথা শুনে মন খারাপ হতো খুব।

তবে বেশি মন খারাপ করা মুহূর্ত তো তিনি নিজেই দিয়েছেন। তিনি যে ঘরানার ব্যাটসম্যান, যে কারণে তাকে ভালোবাসি, সেই ঘরানার কারণেই তিনি ধারাবাহিক হবেন না, কখনোই না, এটা জানি। তবু ভালোবাসার দাবি তো যুক্তি মানে না প্রায়ই!

মানসিক অবসাদের কারণে তিনি বিরতি যান। আমার মনও বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। জন্মদিনের পার্টিতে গিয়ে এমনভাবে পায়ে চোট পান যে অপারেশন করাতে হয়, আমার পা অবশ হয়ে যায়। আরও বেশি বিবশ হয় মন। এটা কোনো কথা!

তার আর অস্ট্রেলিয়ার ভক্ত হিসেবে এই বিশ্বকাপে আমার প্রত্যাশা ছিল, কিছু ক্যামিও ইনিংস আর বল হাতে কার্যকর অবদান রাখা। দ্রুততম সেঞ্চুরি করবেন, মহাকাব্যিক ইনিংস খেলবেন, প্রত্যাশার সীমনায় ছিল না এমন কিছু। হয়তো অবচেতন মন আর অভিমান নিতে প্রস্তুত ছিল না।

নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে তার ৪০ বলের সেঞ্চুরিতে খুব উচ্ছ্বসিত হইনি। হ্যাঁ, ৪০ বলের সেঞ্চুরি পাড়ার ক্রিকেটেও বিশেষ কিছু। কিন্তু তিনি তো ম্যাক্সি, তার জন্য এসব এমন কী!

কিন্তু কালকে যা করলেন, আমার সুদূরতম কল্পনাতেও তা ছিল না। স্বীকার করছি, তার একনিষ্ঠ ভক্ত, তার ভালোবাসায় বুঁদ হয়ে থাকা আমিও এতটা ভাবতে পারিনি। আপনি ভাবতে পেরেছিলেন, কেউ ভাবতে পেরেছিল? এরকম কিছু কি ভাবা যায়!

হ্যাঁ, যারা রূপকথার গল্প লিখেন, যারা কল্পকাহিনী লিখেন, তারা এসব ভাবেন। কল্পনার রঙে ছবি আঁকেন তারা। আমরা সেসবে মুগ্ধ হই, সাময়িক আনন্দে ডুব দেই। জানি, মাথা তুললেই আবার সব শেষ। কারণ, এসব তো অবাস্তব।

কম্পিউটার গেমসে নিশ্চয়ই এরকম ইনিংস আপনি দেখেছেন বা খেলেছেন। আপনি ক্রিকেট নিয়ে খুব ভাবেন, হয়তো প্রিয় ক্রিকেটারকে নিয়েও এমন কিছু কল্পনা করেছেন কখনও, পরে আনমনেই আবার হেসে ফেলেছেন যে, এসব তো আর বাস্তবে হয় না!

ম্যাক্সি সেই বাস্তবা আর অবাস্তবের সীমানাটাই ঘুচিয়ে ফেললেন। সব একাকার করে ফেললেন।

একজন ব্যাটসম্যান ২৯২ রান তাড়ায় ছয় নম্বরে নেমে একাই ২০১ করে ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছেন, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কিছু? একটি ওয়ানডে ম্যাচে অষ্টম উইকেট জুটিতে ডাবল সেঞ্চুরি হয়েছে, সেটিও রান তাড়ায়, এটা কি সম্ভব? ১৭০ বলে ২০২ রানের সেই জুটিতে একজন একাই ১০২ বলে ১৭৯ করেছেন, এটা কি বাস্তবসম্মত?

আপনার-আমার চোখের সামনে হয়েছে। তবু কেমন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঘোর লাগে না? আপনার মনে হচ্ছে না, চিমটি দিলেই ঘুম ভেঙে যাবে? এটা নিশ্চয়ই কোনো সুখস্বপ্ন!

স্রেফ এটুকুই তো এই দুনিয়ার বাইরের কিছু। আমাদের কল্পনার সীমা ছাড়ানো কিছু। আর সেটাও কি না পায়ে ক্র্যাম্প নিয়ে!আমার মনে হচ্ছিল, রোমাঞ্চকর কোনো কিশোর উপন্যাস বা থ্রিলারের মঞ্চায়ন দেখছি যেন।

ম্যাক্সি খোঁড়াচ্ছেন, পা নাড়াতে পারছেন না। ব্যথার কাতর হয়ে শুয়ে পড়েছন। পরমুহূর্তেই আবার উঠে দাঁড়াচ্ছেন। পরের ব্যাটসম্যান অ্যাডাম জ্যাম্পা তিন দফায় তৈরি ছিলেন মাঠে ঢুকে পড়তে, কিন্তু ম্যাক্সি হাল ছাড়েননি।

দলকে জেতানোর নেশার চেয়ে কড়া আফিম আর কিছু নেই বুঝি। ম্যাক্সি বুঝে গিয়েছিলেন, আজ তিনিই ক্রিকেট ঈশ্বর।

সাচিন টেন্ডুলকার দারুণ একটা ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পা নাড়াতে পারছিলেন না বলেই ম্যাক্সির হেড পজিশন খুব স্টেডি ছিল, বলে একদম কাছ থেকে চোখ রেখেছেন এবং ব্যালান্স ছিল নিখুঁত, সাধারণত তিনি যেসবে গড়বড় করেন, এসব জায়গায় তিনি এই ইনিংসে ছিলেন নিখুঁত।

ক্রিকেট খেলাটাই এমন। একটা পথ বন্ধ হলে অনেক পথ খুলে যায়, স্রেফ সেই পথে ছুটতে জানতে হবে। ম্যাক্সি তা জানেন।

কোনো ইনিংস নিয়ে আপনি যতসব বিশেষ আগে ব্যবহার করেছেন, কোনোটাই কি এই ইনিংসের জন্য উপযুক্ত মনে হচ্ছে? অসাধারণ, অভাবনীয়, অকল্পনীয়, অতিমানবীয় – এই ধরনের সব বিশেষণকে কেমন খেলো, কেমন হাস্যকর বা অনুপযুক্ত মনে হচ্ছে না?

কপিল দেবের ১৭৫ রানের ইনিংসের কোনো ভিডিও নেই। সেদিন বিবিসির স্ট্রাইক ছিল। কিন্তু গল্প তো কম পড়িনি। ভিভের ১৮৯ বা ১৮১ নিয়ে কত পড়েছি আর শুনেছি, রোহিত শার্মার ২৬৪, সাঈদ আনোয়ারের ১৯৪ বা আরও যত ইনিংস, কত দেখেছি, কত পড়েছি, কত জেনেছি বা শুনেছি, কোনোটাই কি ম্যাক্সির ইনিংসের সঙোগ তুলনীয়?

স্যার ডন যেমন অবিসংবাদিত সেরা। তার ৯৯.৯৪ যেমন ক্রিকেটের সবচেয়ে বিখ্যাত সংখ্যা। তেমনি ম্যাক্সির ২০১ এখন তর্কাতীত। ব্যস, ফুল স্টপ।

যে ছক্কায় তিনি দলকে জেতালেন আর ডাবল সেঞ্চুরি ছুঁলেন, ড্রেসিং রুমে তালিতে ফেটে পড়লেন ডেভিড ওয়ার্নার আর লাফিয়ে উঠলেন জ্যাম্পা, ধারাভাষ্যে ইয়ান স্মিথ বললেন, ‘এর চেয়ে রিমার্কেবল কিছু ক্রিকেটে আর কখনও কিছু হয়নি…’, রিকি পন্টিং, আমাদের প্রিয় পান্টার বললেন, ‘আমি যথেষ্ট ক্রিকেট খেলেছি আর দেখেছি, কিন্তু এমন কিছু আর দেখেনি…’, তখন আপনি কি ভাবছেন? আমি কি ভাবছি?

একটি তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের চিরদিনের খোরাক। ভালোবাসার অর্ঘ্য। আমার মনে হয়, ম্যাক্সির ইনিংসটি শুধুই আসার জন্ম। কেবলই আমার জন্য। তার প্রতি আমার ভালোবাসার প্রতিদান।

আর কিছু চাইবার আছে? এখনও তো বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল ও ফাইনাল বাকি! তবে ভালোবাসায় এত যদি-কিন্তু চলে না। ম্যাক্সি যে উপহার দিলেন, সর্বকালের সেরা ওয়ানডে ইনিংসের পর আর কিচ্ছু চাইবার নেই, একটুও না।

ম্যাক্সি, আই লাভ ইউ! আই রিয়েলি ডু!

– ফেসবুক থেকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link