More

Social Media

Light
Dark

৩৬ থেকে ৩২৯: এক মহাসমুদ্র যাত্রা

ভাগ্যিস ভারতের স্পোর্টিং টাইমসের মতো কোনো পত্রিকা নেই। নইলে সেই অ্যাশেজের মতো করে ৩৬ কাণ্ড পর ভারতীয় ক্রিকেটের মৃত্যু ঘোষণা করে দিতো তাঁরা।

তার চেয়ে কম কিছুও হচ্ছিলো না।

এই ভারতীয় দলের আদৌ টেস্ট খেলার যোগ্যতা আছে কি না, এসব সব প্রশ্ন তোলা শুরু হয়েছিলো। এই সময়ের ক্রিকেটের সব মহাপ্রাচীর-বিরাট কোহলি, চেতেশ্বর পুজারা কিংবা আজিঙ্কা রাহানের কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন উঠছিলো।

ads

এইসব প্রশ্ন যেনো একটা পর একটা দেয়াল তুলে দিয়েছিলো ভারতীয় দলের সাথে। সেই দেয়াল গাঁথতে দরকার ছিলো গাইতি, হাতুড়ি। কিন্তু ভারতীয় দল থেকে একে একে খসে পড়ছিলো সব অস্ত্র। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় দলটার যা অবস্থা দাড়িয়েছিলো, তাতে কোনো রঞ্জি দল বলে মানাও কঠিন ছিলো। এই দল আর কী করতে পারত!

হ্যা, সেই সহায়-সম্বল, অস্ত্র-শস্ত্র বিহীন লোকগুলোই শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাড়ালো। ৩৬ রানের ছাইভষ্ম থেকে উঠে দাড়িয়ে সেই দলটিই ৩৩ বছর পর গ্যাবা দূর্গের পতন ঘটালো। প্রায় শিশুসূলভ এক দল ভারতকে এনে দিলো অবিশ্বাস্য এক সিরিজ জয়। একে মহাসমুদ্র যাত্রার সাথে তুলনা করলেও কিছুটা কম পড়ে যায়।

ভারতের এই লড়াইটা যত না অস্ট্রেলিয়ার সাথে ছিলো, তার চেয়ে বেশি ছিলো নিজেদের সাথে।

প্রথম প্রশ্নটা তৈরী হয়েছিলো ২০১৮-১৯ মৌসুমে। ওই সময় কোহলির নেতৃত্বে ভারত প্রথবারের মতো অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে সিরিজ জিতে আসে। কোহলি নিজে পরে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, এটা তার কাছে বিশ্বকাপ জয়ের মত বড় অর্জন। কিন্তু সমস্যা হলো, এটাকে লোকেরা ‘বড়’ বলে মানতে রাজী হচ্ছিলো না।

সেই অস্ট্রেলিয়া দলে ছিলেন না স্টিভেন স্মিথ ও ডেভিড ওয়ার্নার। ফলে লোকেরা বলছিলো, টিম পেইনের একটা দুর্বল দল পেয়ে ভারত ফাকে তালে জিতে এসেছে।

এবার ভারতের সেই জবাব দেওয়ার পালা ছিলো। অন্তত সিরিজ শুরুর আগে দু দলই পূর্নশক্তির স্কোয়াড নিয়ে পরিকল্পনা আটতে পারছিলো। ভারতের পরিকল্পনা ছিলো অস্ট্রেলিয়ার পেস সহায়ক উইকেটগুলোতে চার ফাস্ট বোলার লেলিয়ে দেবে এবং দুই স্পিনার জাদেজা ও অশ্বিন এর মধ্যে ভেল্কি দেখাবেন। কিন্তু ওই ৩৬ বিপর্যয় কার্যত ভারতের মানসিক প্রতিরোধ শেষ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো।

এরপর শুরু হলো ইনজুরির প্রকোপ। একে একে চার ফাস্ট বোলারই খেলা থেকে ছিটকে গেলেন। ছিটকে গেলেন জাদেজা-অশ্বিন। সিডনিতে প্রবল ব্যাথা নিয়ে খেললেন হনুমা বিহারী; তিনিও ব্রিসবেনে ছিলেন না। সবমিলিয়ে নিয়মিত একাদশের ৭ জন ছিলেন না ব্রিসবেন টেস্টে। এ ছাড়াও বেঞ্চে থাকা লোকেশ রাহুলকেও পাওয়া যাচ্ছিলো না। এর সাথে নিয়মিত অধিনায়ক ও সেরা ব্যাটসম্যান কোহলি তো প্রথম টেস্টের পর থেকেই নেই। ইনজুরি নিয়ে খেললেন রিশভ পান্থ।

১-১ ড্র নিয়ে বিসবেনে এসেছিলো ভারত।

এখানে ম্যাচটা ড্র করতে পারলেই সম্মান বাঁচে। অন্তত অ্যাওয়েতে ড্র করার ফলে ট্রফিটা নিয়ে ফিরতে পারে ভারত। এই ভাঙাচোরা ভারতের কাছে তখন ব্রিসবেনে ড্রটাই স্বপ্নের মতো ব্যাপার।

একবার ব্রিসবেনের দিকে চেয়ে দেখুন।

এখানে অস্ট্রেলিয়া শেষ যখন হেরেছে, তখন এই ভারত-অস্ট্রেলিয়া দলের অনেক খেলোয়াড়ের জন্মই হয়নি। ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে অ্যালান বোর্ডারের অস্ট্রেলিয়া এখানে হেরেছিলো ভিভ রিচার্ডসের ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে। এরপর থেকে স্টিভ ওয়াহ, রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্ক, স্টিভেন স্মিথ থেকে এই টিম পেইন পর্যন্ত; অস্ট্রেলিয়ার কোনো অধিনায়ক এখানে আর ম্যাচ হারেননি।

গ্যাবায় অস্ট্রেলিয়া ৬২টি টেস্ট খেলেছে। এর মধ্যে মাত্র ৮টি, হ্যা, ৮টি টেস্টে হেরেছে তারা কোনো দলের কাছে। সেই ১৯৩১ সাল থেকে এই একটা ভেন্যুতে মাত্র ৮ বার হারাতে পেরেছে তাদের কোনো সফরকারী দল।

সৌরভের দল ২০০৩ সালে গ্যাবায় ড্র করেছিলো। সেটা করতে পারাই তখন রাহানের দলের জন্য স্বপ্নতূল্য। কারণ, না আছে তাঁদের হাতে না আছে কামিন্স-স্টার্কদের সামলানোর মতো ব্যাটসম্যান। না আছে স্মিথ-লাবুশেনদের টলানোর মতো বোলার।

হ্যাঁ, বোলিংটাই মূল সংকট।

জাদেজা অলরাউন্ডার হওয়াতে ভারত ৬ বোলার এফোর্ড করতে পারছিলো আগে। এখন সেই ৬ জনই ইনজুরিতে। ফলে ভারত এক ঝাক অভিষিক্ত বা এক দুই ম্যাচের অভিজ্ঞ বোলার নামালো মাঠে। গ্যাবায় এসব তরুন বোলারের জন্য নিজের ‘র পেস’ নিয়ন্ত্রন রাখাই কঠিন; উইকেট নেওয়া তো পরের আলাপ। কিন্তু সেই তরুনরাই রুখে দাড়ালেন।

শার্দুল ঠাকুর ও ওয়াশিংটন সুন্দর তো ব্যাটে-বলে চমকে দিলেন। রানও করলেন, উইকেটও নিলেন। আর সিরাজ তার প্রয়াত বাবার জন্য লড়াইটা চালিয়ে গেলেন; তুলে নিলেন প্রথম ৫ উইকেট। তবে সেরা জবাবটা জমিয়ে রেখেছিলেন সম্ভবত পান্থ।

পান্থ কেনো টেস্ট দলে, এই প্রশ্নের জবাব অনেকেই খুজে পাচ্ছিলেন না। পরপর দুই টেস্টে জবাবটা চোখে আঙুল দিয়ে দিয়ে দিলেন।

আজ সকালেও ভারতের জয়টা অতো নিশ্চিত কিছু মনে হচ্ছিলো না। কিন্তু একদিকে পুজারা প্রবলভাবে উইকেট কামড়ে পড়ে রইলেন। অন্য দিকে পান্থ এসে আক্রমণের পসরা সাজিয়ে তুলে নিলেন জয়।

এটা কী কেবলই একটা জয়?

মোটেও না। এটা সম্ভবত আধুনিক যুগে ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। গত কয়েক বছর ধরেই ভারতীয়রা দাবি করছে, তারা বিশ্বসেরা টিম বানাতে পেরেছে। সেই দাবির পক্ষে দাড়িয়ে তাদের রিজার্ভ বেঞ্চ জানালো, তাদের ক্রিকেটটাই বিশ্বসেরা হয়ে উঠেছে।

এই ভারতের মহাসাগর জয়ের নামান্তর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link