More

Social Media

Light
Dark

আতাহার, দ্য স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান

‘হোয়াট আ শট, ভিক্ট্রি শট দেয়ার – ফ্রম আফতাব আহমেদ, ব্রিলিয়ান্ট, টেইক দ্যাট অস্ট্রেলিয়া!

– বাংলাদেশে যাদের শিরা উপশিরাতে ক্রিকেট প্রবাহিত হয় তাদের কানে এই পংক্তিটুকু এক মধুর সংগীতের মতো আজও ভাসে এবং বোধকরি আজীবন ভাসবে ।

উপরের কথাগুলো দিয়ে যিনি কার্ডিফ কাব্যের যবনিকা টেনেছিলেন তিনি এদেশের ক্রিকেটে এক জীবন্ত কিংবদন্তি, এভাবেই দুই দশক ধরে আমাদের কর্ণ কুহরে অনেক অম্ল-মধুর ইতিহাসের বর্ণনা দিয়ে চলেছে মিস্টার খান। একটু আহ্লাদে অনেকে তাঁকে ডাকেন, ‘ভয়েস অফ বাংলাদেশ ক্রিকেট’ বলে। তিনি আতহার আলী খান।

ads

তবে হ্যাঁ, যিনি নন্দিত তিনি অনেক জায়গায় নিন্দিত ও হন। খান সাহেবের ক্ষেত্রে এর ব্যাতিক্রম হবে তা ভাবার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। সামাজিক মাধ্যমের এই যুগে ট্রল নামক ব্যাধি তাকেও আক্রান্ত করে প্রায়সই। সে যাই হোক, মুগ্ধতা ছড়ানোই আমার এই লিখার একমাত্র উদ্দেশ্য। তাই অন্তত আজকে নিন্দুকেরে বাসিবো না আমি সবচেয়ে ভালো।

লেখাটা শুরু করেছিলাম আতাহার আলী খানের দেয়া একটি ঐতিহাসিক ধারাবিবরণী দিয়ে। হায়, অনেকটা নিয়তি বলতে হবে। ভাষ্যকার আতাহার এর জমকালো ক্যারিয়ারের কারণে খেলোয়াড় আতাহারের অনেক কীর্তি ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।

শুরুতে আতাহার আলী খান সম্পর্কে একটা মজার তথ্য। তাঁর স্কুলের বেশির ভাগ এবং কলেজ জীবন কেটেছে পাকিস্তানের করাচিতে। ৭০ এর দিকে আতাহার সাহেবের বাবা সপরিবারে চলে যান পাকিস্তান এবং ফিরেন ১৯৭৭ সালের দিকে।

বাংলাদেশে ফেরার পর তিনি আবাহনীর হয়ে শুরু করেন ঘরোয়া ক্রিকেট, এক বছর পর দল বদলে সূর্যতরুণে পাড়ি জমান।

তবে আতাহারের পাদপ্রদীপে আসা হয় ১৯৮৫ সালে। পার্শ্ব চরিত্রের জন্য যদি বাংলাদেশ ক্রিকেটে কোন অস্কার থাকতো তবে নির্ঘাত আতাহার আলী খান দুই বার অস্কার জিততেন। প্রথমবারের ঘটনাটি এই ১৯৮৫ সালে। তখন দেশে তিন দিনের ম্যাচের একটি টুর্নামেন্ট হতো।

উইলস কাপ ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ, তার সেমিফাইনালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছিলেন তারিকুজ্জামান মুনির। আতাহার করেছিলেন ১৫৫। পঞ্চম উইকেটে তাদের ৪১৭ রানের পার্টনারশিপ এখনো বাংলাদেশের যেকোনো পর্যায়ের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পার্টনারশিপের রেকর্ড।

তার আরেকটি পার্শ্ব কীর্তি হলো ১৯৯৭ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে মোহাম্মদ রফিকের সাথে করা ১৩৭ রানের ওপেনিং জুটি, যা আমাদের প্রথম ওয়ান ডে জয়ের স্বাদ এনে দেয়। মোহাম্মদ রফিক ৭৭ রান করে ম্যাচ সেরা হন, আর আতাহার করেন ৪৭ রান।

যদিও তার কয়দিন আগে কেনিয়াকে আমরা আইসিসি ট্রফির ফাইনালে বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে হারিয়েছিলাম কিন্তু সেই সময় কেনিয়া আমাদের চেয়ে অনেক ভালো দল ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঐদিন আতাহার এবং রফিকের পার্টনারশিপ না হলে হয়তো প্রথম জয় পেতে আমাদের আরো ২ বছর অপেক্ষা করতে হতো।

এবার ব্যাক্তিগত অর্জনের কথা যদি ধরি, ১৯৯০ সালের শেষ দিন এশিয়া কাপে কলকাতার ইডেন গার্ডেনসে ৫০,০০০ দর্শকের সামনে আতাহার খেলেন ৭৮ রানের এক অবিস্মরণীয় ইনিংস। প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কার ডেরায় তখন প্রমদায় বিক্রমাসিংহে, চম্পকা রমানায়েকে, সনাৎ জয়াসুরিয়ার মতো বোলার। সেই ম্যাচে অরবিন্দ দি সিলভা বেশি রান করলেও ম্যাচ সেরা হন আতহার আলী খান, বাংলাদেশি কোনো খেলোয়াড় প্রথম বারের মতো এই পুরস্কার পান সেদিন। সেটা ওই আসরেরই অন্যতম সেরা ইনিংস ছিল।

তবে তাঁর ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ রান আসে ১৯৯৭ সালে এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে, ৮২ রান। ওই বারের এশিয়া কাপে ৩ ম্যাচে ১৫৭ রান করেন আতাহার। ইনজামাম, সেলিম মালিক, শচীনদের পিছনে ফেলে সর্বোচ্চ রান তোলার তালিকায় পঞ্চম ছিলেন সেবার। তিনি কোচ মহিন্দর অমরনাথের প্রিয়পাত্র ছিলেন। তাঁর ইচ্ছাতেই চার নম্বর থেকে প্রমোশন পেয়ে খেলেন ওপেনিংয়ে।

১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়ে আতাহারের ভূমিকা না বললেই নয়। নয় ম্যাচে করেছিলেন ১৭০ রান। কিন্তু ধীর গতির ব্যাটসম্যান, এই অজুহাতে ফাইনাল ম্যাচে দলে থাকলেও ব্যাট করার সুযোগ হয় নি। সেদিন বৃষ্টি বিঘ্নিত কার্টেল ওভার ম্যাচে জয়ের জন্য বাংলাদেশের দরকার ছিল ২৫ ওভারে ১৬৬ রান।

নিয়মিত ওপেনার আতাহারের জায়গায় ব্যাট করতে পাঠানো হয় নাঈমুর রহমান দুর্জয়কে। সেই ম্যাচে দুর্জয়ের অবদান ছিল ১ বলে ০ রান। একটু ধীর ব্যাটিং করেন বলে সেই ম্যাচে আর ব্যাট হাতে নামাই হয়নি আতাহারের।

১৯ ম্যাচের ছোট আন্তর্জাতিক ওয়ান ডে ক্যারিয়ারে আতাহার তিন হাফ সেঞ্চুরির সৌজন্যে  রান করেন ৫১২। গড় ২৯.৫৫ , ২০০২/০৩ সাল পর্যন্ত যা বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রান এবং সর্বোচ্চ গড় হয়ে টিকে ছিলো। তারপরও ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে খেলা হয়নি তাঁর। স্কোয়াডে তাঁকে এবং মিনহাজুল আবেদীন নান্নুকে না রাখায় অনেক সমালোচনা হয়েছিল। নান্নুকে পড়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, ফেরানো হয়নি আতাহারকে।

আতাহার আলী খান কেবল ব্যাটিংয়ে নয়, বোলিংয়েও ছিলেন কার্যকর। তার মিডিয়াম পেস বোলিংয়ের অ্যাকশনটা স্টাইলিশ ছিল। ১৯ ওয়ানডেতে ছয় উইকেট নেন। ভাল মানের পেস বোলিং অলরাউন্ডার ছিলেন, যার জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেটের হাহাকার বহুদিনের।

তার ব্যাপারে একটা মজার তথ্য না দিলেই নয়। আতাহারের ধারাভাষ্য কক্ষে অভিষেক কবে জানেন? যেদিন প্রথম বাংলাদেশ টেস্ট খেলতে নামে, সেদিন। আধ ঘন্টা করে দুই বারে এক ঘন্টা ধারাভাষ্য দেন আতাহার। শুনবেন কে ছিল তার প্রথম কমেন্ট্রি পার্টনার? – ইয়ান চ্যাপেল। সেদিন থেকেই শত শত ভিনদেশির ‘খোঁচা’ উপেক্ষা করে আমাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link